আমাদের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা


জসিম উদ্দীন মাহমুদ

১৯৭২ সনে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘রাষ্ট্রীয় মূলনীতি’ হিসেবে আমরা পেয়েছি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ । আমরা এই শব্দগুলোর অর্থ, সংজ্ঞা, কার্যকারিতা, বাস্তবতা কতটা বুঝি, জানি, অনুধাবন করি সে বিষয়ে না গেলেও এ কথা সত্য যে, আমাদের মুক্তি যুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ছিল জাতিগতভাবে যাদের আমরা শক্র গণ্য করেছি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং তাদের দখলদারি থেকে দেশ-অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক ভূখন্ড শক্র মুক্ত করা। এই লড়াইয়ের সময় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, শোষণ নিপীড়ন থেকে মুক্তি ইত্যাদি নানান ধারণা শ্লোগান কর্মসূচি আমরা দেখেছি। কিন্তু আভ্যন্তরীণ দিক থেকে যে-রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারিত হয়, গঠনের প্রক্রিয়া ও ফলাফলে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, সেই লড়াই আমরা করি নি। যদিও আমরা গণতন্ত্র নিয়ে কথাবার্তা শ্লোগান হুংকার দিয়েছি। কিন্তু কী করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হয়, সেই লড়াইয়ে শক্রমিত্র কী করে ঠিক হয়-সেই সব বিষয়ে আমাদের ভাবনাচিন্তা আজ অবধি খুবই দুর্বল।
সাধারণত সমাজের সংবেদনশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই সকল বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক আলাপ আলোচনা চলে। এই তর্কবিতর্ক থেকে বিভিন্ন শ্রেণী তাদের নিজ নিজ শ্রেণীর পক্ষে যুক্তি সন্ধান করে, তত্ত¡ পায় এবং আন্দোলন-সংগ্রামে, সমাজে নিজ শ্রেণীর আধিপত্য কায়েমের জন্য চেষ্টা চালায়। কিন্তু বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীতার বিচার করলে আমরা দেখব যে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য তাত্বিক লড়াই-সংগ্রাম কখনই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ঠিক যতটা ছিল “সমাজতন্ত্র’ কায়েমের জন্য আকুতি ও আবেগ।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটেছে। আমাদের স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে  হয়েছে অনেক । কিন্তু এতো মূল্য দিয়ে ষে রাষ্ট্র আমরা গঠন করেছি চরিত্রের দিক থেকে তা কতটা গণতান্ত্রিক তা আজ প্রশ্নসাপেক্ষ । একটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক স্বাকৃতি লাভ করা মানে  গণতান্ত্রিক-এমন কোন কথা নেই । 

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান ও আবশ্যিক শর্ত একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান । বাংলাদেশের সংবিধান কতটা গণতান্ত্রিক সেটা সকলেই জানেন। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত গণতন্ত্রের চেয়ে ক্ষমতাতন্ত্রের চার্চাই  হয়েছে এই সংবিধানের ওপর দিয়ে । ফলে যখন যারা ক্ষমতায় এসেছে, গেছে, প্রায় সকলেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে নিজেদের সুবিধামত নিজেদের মত করে সংবিধান কাটছাট করেছে। যার ফলে স্বাধীন রাষ্ট্র বসবাস করেও এদেশের সাধারণ জনগণ স্বাধীনতার সুফল থেকে বঞ্চিত  হয়েছে, হচ্ছে।

আমরা জানি স্বাধীন অর্থ স্ব-অধীন। যে কেবল নিজের অধীন, স্ববশ, অন্যপর, অবাধ, স্বাচছন্দ, অপরের আজ্ঞাবহ নয়, স্বনির্ভর বা অন্য কারো উপর নির্ভরশীন নয়, আভিধানিক অর্থে সে স্বাধীন। স্বাধীন একটি বিশেষণ বাচক শব্দ। এর বিশেষ্য হলো স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার । এই স্বাধীনতা ব্যক্তি সাজ ও জাতীয় জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সর্বদা সর্বজন কাঙ্খিত এবং স্বাধীনতা দুনিয়ার অসংখ্য নিয়ামতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নিয়ামত।

ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং সমাজ ও জাতির ক্ষেত্রে এটা সামাজিক, রাষ্ট্রিয়, বা জাতীয় স্বাধীনতা: এগুলো এক একটি আলাদা শব্দ হলেও অর্থ ও কার্যকারিতার দিক থেকে পরস্পর সম্পূরক বা সমার্থক। ব্যক্তি স্বাধীনতা ব্যতিত সামাজিক ও জাতীয় স্বাধীনতা যেমন অর্থহীন, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বাধীনতাও তেমনি খর্বিত। অতএব, স্বাধীনতা হতে হবে সার্বিক। ব্যক্তি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যখন অন্যের অধীনতা ও খবরদারী থেকে যুক্ত  হয়ে স্বাধীন ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছু করতে পারে, সর্বোপরি বিশ্বের দরবারে স্বীয় স্বাধীন সত্তা ও মর্যাদা নিয়ে মাথা উচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয় তখন সেটাকেই যথার্থ স্বাধীনতা বলে অভিহিত করা চলে।

তবে স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। যা খুশী তাই করার দাম স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা বলতে নিজের যেসব অধিকার বুঝায়, অন্যের ক্ষেত্রেও সেসব অধিকার নিশ্চিতকরণের মধ্যে স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য নিহিত ।  একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যেমন একটি সংবিধান দরকার, একটি সমাজ পরিচালনার জন্যও তেমনি কতগুলো নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান প্রয়োজন। মানুষ সামাজিক জীব । সমাজের অন্য সকল মানুষের সাথে মিলে মিশে সামষ্টিক কল্যাণ ও পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সফলের সমঅধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে শান্তি পূর্ণ সহাবস্থানের নীতি মেনেই তাকে চলতে হয়। ইংরেজীতে এটাকে বলা হয় চবধপবভঁষ পড়বীরংঃবহপব অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান । অন্যভাবে এটাকে এরাব ধহফ ঃধশব ঢ়ড়ষরপু অর্থাৎ পারস্পরিক লেন-দেন নীতিও বলা চলে। সমাজে যে কোন ব্যক্তি জীবনধারণের প্রয়োজনে সর্বক্ষণ সমাজ থেকে কিছু না কিছু গ্রহণ করতে হয়। অনুরূপভাবে, সমাজকে বিভিন্নিভাবে অহরহ কিছু না কিছু তাকে দিতেও হয়।
সমাজ থেকে যা কিছু সে নেয়, সেটা হলো তার অধিকার আর সমাজকে সে যা কিছু দেয় সেটা হলো সমাজ ও মানুষের প্রতি তার দায়িত্ব-কর্তব্য। যে সঙ্গে তার নাগরিককে মত পিশি সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার প্রদান করে, সে সমাজ তত উন্নত, সুন্দর ও জনকল্যাণকামী সভ্য সমাজ। আবার যে সমাজের নাগরিকগণ তাদের নাগরিক ও সামাজিক দায়িত্ব যত বেশি সুষ্ঠু ও যথাযথভাবে পালন করে সে অনুযায়ী তাদেরকে সমাজের আদর্শ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে পণ্য করা হয়। এভাবে সুষ্ঠ সামাজিক ব্যবস্থা, উন্নত সুশীল নাগরিক জীবনের জন্য সমাজ ও সামাজিক ব্যক্তিদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা তথা পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা প্রত্যেক নাগরিকের জন্যই একান্ত অপরিহার্য । আর এ বিষয়ে যত সচেতন হওয়া যাবে ততই স্বাধীনতার সুফল লাভ সহজ হবে।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক।

প্রকাশিত: 
মাসিক আর-রায়হান 
রবিউল সানি ১৪৪০ হিজরী, জানুয়ারী ২০১৯ ইং

No comments

Powered by Blogger.