পবিত্র কুরআন-হাদিসের ভাষায় মানবকল্যাণ
মুহাম্মদ আবুল হাসান মাহবুবুর রহমান*
মানুষ সামাজিক জীব হিসাবে সমাজ বন্ধ হয়ে বসবাস করে৷ সমাজবন্ধ হয়ে বসবাস করতে হলে পরস্পরের সহযোগিতা প্রয়োজন : মহান আল্লাহ এ সুন্দর পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টির সেরা করে পাঠিয়েছেন। আর সৃষ্টি কুলের জীবজন্তু পশু, পাখি, কীট-পতঙ্গ, পাহাড়-পর্বত, গাছ-পালা ইত্যাদি মানুষের উপকারের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং এসব সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি দেখানো এবং এগুলোর যত ও রক্ষনাবেক্ষণ করা অবশ্য কর্তব্য । যে সৃষ্টির প্রতি দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করে আল্লাহ তা'লা তার প্রতি খুশি হয়ে রহমত বর্ষণ করেন। মহানবী (স.) বলেছেন, তোমরা জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া করবে তা হলে আসমানের অধিপতি মহান আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করবেন । মানুষের উপর প্রধানত
দুই ধরণের কর্তব্য আছে। প্রথমত সষ্টার প্রতি কর্তব্য দ্বিতীয়ত সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য । সৃষ্টির প্রতি মানুষের কর্তব্য হল অসহায় দুঃস্থ মানুষকে সাহায্য ও সহযোগিতা করা সাথে গাছ-পালা, পশু-পাখি, বৃক্ষ-লতা ও পরিবেশের প্রতি ও মানুষের কর্তব্য রয়েছে এবং এদেরকে অবহেলা করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। মিশকাত শরীফে আছে “সমগ্র সৃষ্টি জগৎ আল্লাহর পরিবার, আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিটি প্রিয়, যে তার পরিবারের প্রতি বেশি অনুগ্রহণ করেন।
পশু-পাখি, গরু-ছাগল, হাস-মুরপি, কুকুর, বিড়াল প্রভৃতি সকল প্রাণীই ক্ষুধা ও পিপাসা আছে। এদের খেতে দেয়া আমাদের দায়িত্ব । সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে, কোন এক মহিলা এক বিড়াল বেঁধে রাখে, সে বিড়ালটিকে খেতে দেয়নি এবং ছেড়ে ও দেয়নি যাতে পোকা-মাকড় খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে । অবশেষে বিড়ালটি বাধা অবস্থায় খাদ্যভাবে মারা গেলে আল্লাহ তা'লা এ মহিলাকে শান্তি দেন। এঁ সহীহ হাদিসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, বনি ইসরাঈলের এক পাপী মহিলা একটি ক্ষুধার্ত কুকুরকে পিপাসায় কাতর দেখে পানি পান করান । এতে আল্লাহ তা'লা এ মহিলার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পাছ-পালা রক্ষার গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে অকারণে গাছ-পালা কাটা উচিত নয়। গাছের পাতা ছেড়া ও চারা গাছ উপরে ফেলা উচিত নয়, বৃক্ষ লতাও মহান আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করে।
মানুষ ও আল্লাহ তা'লার মাখলুকাত, তাই বলে মানুষ অন্যের নিকট সাহায্যের হাত প্রসারিত করলে চলবে না। অন্যের দ্বারস্থ না হয়ে পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্যন্নোতি করার প্রতি ইসলাম যে শিক্ষা দিয়েছে তা নিম্নে বর্ণনা করা হল ঃ-
মানুষ নিজ হাতে পরিশ্রম করে নিজের জীবিকা অর্জন করবে এবং কখনো অন্যের দ্বারস্থ হবে না এটাই
ইসলামের শিক্ষা । ইসলাম মানুষকে যেকোন শ্রমের কাজ করতে উৎসাহিত করে । নিজের এবং নিজের পরিবার পরিজনের ভরনপোষণের জন্য মানুষ যে কোন মেহনতের কাজ করতে পারে এতে মর্যাদাহানি বা লোক ভয়ের কিছু নেই। নিয়ে শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীসের উল্লেখ করা হলো-
“রাসুলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, কোন ব্যক্তির জন্য উত্তম এবং ভাল থেকেও ভাল খাদ্য হলো তার নিজের হাতের রোজগার । হযরত দাউদ (আ:) নিজ হাতে রোজগার করে খেতেন।”
“হযরত খালেদ হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) কে একদা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, মানুষের কোন কাজ সবচাইতে শ্রেষ্ঠ ? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “মানুষ নিজের হাতে যে কাজ করে।”
রসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, “মজুরের কাজই শ্রেষ্ঠ কাজ, যখন সে বিশ্বস্ততার সহিত তা সম্পাদন করে।”
কোদালি চালাতে চালাতে একজন সাহাবীর হাতে কালো রেখা পড়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (দ.) তার হাতঙুলি দেখে বললেন : তোমার হাতের মধ্যে কি কিছু লিখে রেখেছ সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল এগুলি কালো দাগ ছাড়া কিছুই নয়, আমি আমার পরিবার পরিজনের ভরণপোষনের জন্য পাথুরে জমিতে কোদাল চালাই, তাই এই দাগগুলি পড়েছে। রাসূলুল্লাহ (দ.) একথা শুনে সাহাবীর হাতে চুমু খেলেন আবু হোরায়রা হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, আল্লাহ তা'লা এমন কোন নবীই পাঠাননি যিনি মেষ চরাতেন না। তখন সাহাবীরা বললেন, আপনিও তিনি বললেন, হ্যা আমিও কয়েক কিরাত মজুরীতে মক্কাবসীদের মেষ চরাতাম।
জনৈক সাহাবী একদা রাসূলুল্লাহকে (দ.) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ । শিকার করা আমার পেশা । তাই জামাতের সাথে নামায পড়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। রাসূলুল্লাহ (দ-) বললেন কী সুন্দর পেশা তোমার? আমার পূর্ববর্তী সকল নবীই শিকার করতেন। যারা মুকীম (অর্থাৎ বাড়ীতে অবস্থান করে, তারাই জামাতে নামায পড়বে রুজির তালাশে থাকার দরুন যদি জামাতে হাযির হতে না পার তাহলে আদায়কারী এবং খোদাপ্রিয় লোকদের প্রতি ভালবাসা রাখ, এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট । নিজের পরিবার পরিজনের জন্য বৈধ ভাবে রুজির অর্জন কর। কেননা এটা হচ্ছে আল্লাহর পথে জিহাদ।
যারা সত্যিকারের অক্ষম, যারা অনাথ, অন্ধ, পঙ্গু অথবা নিরাশ্রয় ইসলাম তাদের ভরনপোষণের দায়িত্ব মুসলমানদের উপর ন্যস্ত করেছে। ইসলামের শিক্ষায় উদ্ব্দ্ধু হয়ে মুসলমানরা এক্ষেত্রে যেসব দৃষ্টান্ত কায়েম
করে গেছেন তা যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে । নিয়ে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা হলো ঃ-
হযরত আবু বকর (রা.) এর খেলাফতকালে একবার আরবে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ঠিক তখনই পণ্যবোঝাই এক হাজার উট সিরিয়া থেকে মদীনায় আসে।
উট এবং উটের বোঝাইকৃত পণ্যসামগ্রীর মালিক ছিলেন হযরত উসমান (রা.)। উটগুলি মদীনায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পণ্য খরিদ করার উদ্দেশ্য হযরত উসমান (রা.) এর চারিদিকে জড় হয় এবং দামদর শুরু করে। হযরত উসমান কোন দামেই পণ্য বিক্রি করতে রাজি হলেন না। কেবল বলতে লাগলেন এ দামে আমার পোষাবে না, আমি আরো বেশি দাম চাই।” অনেক দরদস্তরের পর মদীনার ব্যবসায়ীরা উসমান (রা.) বললো “আপনি আর কত চান ? আমরা মদীনায় সব ব্যবসায়ীরাইতো এখানে উপস্থিত এর চেয়ে বেশি দাম আর কে দেবে হবরত উসমান (রা.) বলে উঠেন, একমাত্র আল্লাহই তা দিতে পারেন। কেননা আল্লাহ একের বদলে দশ কিংবা এর চেয়ে বেশি ও দিতে পারেন। তোমরা সবাই সাক্ষী যাতে আমি সমস্ত পণ্য সামগ্রী আল্লাহর ওয়াস্তে গরীব ও অসহায় লোকদের দান করলাম।
হযরত ওমর (রা.) এর আর্থিক অবস্থা মোটেও স্বচ্ছল ছিল না. তাই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে খায়বর অঞ্চলের একখন্ড জমি প্রদান করা হয়। হযরত ওমর (রা.) জমি প্রান্তির সংবাদ শুনে সোজাসুজি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে গিয়ে নিবেদন করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (দ.) এত মুল্যবান জিনিসের অধিকারী আমি জীবনে হয়নি। এর দ্বারা আল্লাহ আমাকে এক মহান পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন, অতএব আপনি নির্দেশ দিন কিভাবে আমি একে জনসাধারণের সেবাই নিয়োজিত করতে পারি। তখন প্রিয় নবীজি বললেন তুমি ইচ্ছা করলে সেটি নিজেই ব্যবহার করতে পার অথবা জনগণের সেবাই নিয়োজিত করতে পার । হযরত ওমর (রা.) একথা শুনা মাত্র জমির যাবতীয় উপস্বত্ব অসহায়, পঙ্গু এবং দুস্থ লোকদের জন্য ওয়াকফ করে দিলেন অবশ্য তিনি এ শর্ত আরজ করলেন যে, ওয়াকফের রক্ষনাবেক্ষণকারীর আয় থেকে নিজের আবশ্যকীয় খরচ চালাতে পারবে।
মদীনা শহরের এক নিভৃত অঞ্চলে এক জনৈকা অন্ধ স্ত্রীলোক বাস করতেন। বাধ্যক্যের ভারে তার দেহ নেতিয়ে পড়েছিল। তাকে দেখা শুনা করার মতও কোন লোক ছিলনা । হযরত ওমর (রা.) প্রতিদিন ভোরে উঠে স্ত্রীলোকটির সেবা এবং আবশ্যকীয় কাজ কর্মাদি করে দিয়ে আসতেন। কিছুদিন পর তিনি দেখতে পেলেন যে, তার আগেই কে একজন লোক বৃদ্ধার সমস্ত কাজকর্ম করে দিয়ে চলে যায়। বৃদ্ধা চক্ষুহীনা, তাই এ লোক সম্পর্কে বৃদ্ধ হযরত ওমর (রা.)কে কোন তথ্য দিতে পারলেন না। হযরত ওমর (রা.) লোকটির পরিচয় জানার জন্য অত্যন্ত কৌতুলী হয়ে উঠলেন। পরদিন অতি প্রত্যুষে তিনি বৃদ্ধার ঘরে দিয়ে দেখলেন যে, সমস্ত কাজকর্ম সেরে দিয়ে স্বয়ং খলিফা আবু বকর (রো.) বৃদ্ধারগর্থ কুঠির থেকে বেরিয়ে আসছেন। হযরত ওমর (রা.) বিস্মিত হয়ে বলে উঠলেন, আমার প্রাণ আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, হে মহানবীর খলিফা, আপনিই তাহলে প্রত্যেকদিন আমার আগে বৃদ্ধার এখানে এসে পৌছান।
মানবাধিকারের ক্ষেত্রে খলিফা ওমর (রা.) বিধর্মীদের ব্যাপারে যে অবদান. রেখেছেন তা মুসলিম খলিফাদের আদর্শের এক উজ্জ্বল দীর্ষ হিসাবে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে যে. খলিফা ওমর (রা.) একদিম দেখতে পেলেন যে, একজন অন্ধ ইহুদী দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছে, তিনি দয়া পরবেশ হয়ে তার কাছে গেলেন এবং কেন তার এরূপ দুরাবস্থা হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে অভিযোগ এবং বাধাক্যই আমার এ দুর্দশার মূল কারণ। হযরত ওমর (রা.) তাকে আপন ঘরে নিয়ে গিয়ে ঐদিনকার আবশাকীয় জিনিসপত্র দিয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি বায়তুল মালের খাজাঞ্চিকে এই ইহুদী এবং এর মত অন্যান্য অসহায় লোকদের উপর থেকে জিজিয়া কর রহিত করে তাদের জন্য বায়তুল মাল থেকে নিয়মিত ভাতা দিতে নির্দেশ দিলেন।
হযরত ওমর (রা.) এর খেদমত কালে একবার আরবে ভয়ানক দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। জরুরী অবস্থা মোকাবেলার জন্য হযরত ওমর (রা.) সিরিয়া ও মিশর থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য শস্য আমদানী করেন তারই নির্দেশে সিরিয়া থেকে হবরত আবু ওমর (রা.) ৪০ চার হাজার উট বোঝায় খাদ্যশস্য মদীনায় প্রেরণ করেন। হযরত ওমর বিন আস (রা.) এর মাধ্যমে মিশর থেকেও একশত খাদ্য বোঝায় নৌকা এসে পৌছে।
হযরত ওমব (রা.) এসমস্ত খাদ্য শস্য অতন্ত্য সুষ্ঠভাবে দুস্থ জনসাধারণের মধ্যে বন্টনের ব্যবস্থা করেন তবু তাঁর মনে যেন কোন শান্তি ছিল না। জনসাধারণের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি ঘি খাওয়া মাংস ও ময়দার রুটি খাওয়া একেবারে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কেন না এই সমস্ত জিনিস অর্থ সামর্থ তখন দেশের গরীব জনসাধারণের ছিলনা, তিনি ঐ সময় কেবল যবের রুটি দ্বারা ক্ষুধা নিবৃত্তি করতেন কখনো কখনো এর সাথে সামান্য জয়তুন তেল মিশিয়ে নিতেন। রুটি না হওয়া সত্তে¡ও দীর্ঘদীন পর্যন্ত এ সমস্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে তাঁর দেহের একদম বিগড়ে গিয়েছিল । ইসলাম মানবতার ধর্ম । মানুষের সর্বাঙ্গনে কল্যাণ সাধনই ইসলাম ধর্মের কাম্য, ইসলাম তথা কুরআন-হাদিসের শিক্ষা স্বাধীনভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে শাস্তির ধারা বয়ে যেতে পারে, নানা সামস্যায় জর্জরিত আসহায় মানুষের জন্য আমাদের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত করা ও মানুষের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ইসলামই কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে, যা অন্য ধর্মের মাধ্যমে কষ্মিনকালেইও সম্ভব নয়।
*হেড মাওলানা,
আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
প্রকাশিত:
মাসিক আর-রায়হান
রবিউল সানি ১৪৪০ হিজরী, জানুয়ারী ২০১৯ ইং।
No comments