যে কারণে খুলনা দরবার শরীফ হক ও শ্রেষ্ঠ - মুহাম্মদ নুরুল আবছার

 


ডাউনলোড


যে কারণে খুলনা দরবার শরীফ হক শ্রেষ্ঠ

মুহাম্মদ নুরুল আবছার

 

১৯৮৬ সালে গাউছে খুলনবীর বার্ষিক পবিত্র ওরছ মাহফিলে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে মতিন ভাই আমি এবং আবু তৈয়ব চৌধুরীকে নির্দেশ দেন উদ্দেশ্যে হলো- বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ওরছে যারা আসবেন তাদের কাছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার দাওয়াত পৌছানো দলের পরিচিতি, বই-পুস্তক এবং বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রকাশনা সমূহ সাথে নিয়ে আমরা ফিরিঙ্গি বাজারের খানকাহ শরীফে বর্তমান চাটগামী হুজুর মুবারকের সাথে দেখা করি তিনি আমাদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পরামর্শ দিয়ে তার কাফেলার সাথে যাওয়ার কথা বলেন

নির্দিষ্ট দিনে আমরা বটতলী রেল ষ্টেশন থেকে চাঁদপুর পৌঁছে জলপথে আগে থেকে রিজার্ভ করা বিশালাকারের জাহাজ দু'টির একটিতে উঠে কেবিনে অবস্থান করেনিই চাটগামী হুজুর মুবারক ব্যক্তিগতভাবে আমাদের অবস্থান, থাকা-খাওয়া এবং সুবিধা অসুবিধার খোঁজ নিচ্ছিলেন যেহেতু আমরা সে দরবারের মুরিদ ছিলাম না তাই শত শত মুরীদের মধ্যে নিজেদেরকে কেমন কেমন মনে হচ্ছিল কিন্তু না হুজুর মুবারকের নির্দেশে সবাই সুন্দর আচরণ করতে থাকেন খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম এবং সুবিধা- অসুবিধার খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন প্রায় দুইদিন সাগরে ভেসে সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য অবলোকন, করত: আমরা নির্দিষ্ট দিন সন্ধ্যা বেলায় দরবার শরীফে পৌছি লক্ষ্য করলাম যে, “চাঁটগামী হুজুর কাফেলা সহ পৌঁচেছেন সেখানে এক রব পড়ে যায়, সবাই তাঁর এছতেকবালীর জন্যে এগিয়ে আসতে থাকেন হুজুর মুবারকের জন্যে একটি চেয়ার আনা হয় দুই জাহাজ থেকে সবার অবতরণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানে উপবিষ্ট থাকেন

তিনি উক্ত দরবারের খলিফা হলেও তাঁর প্রতি মূল দরবারের বিশেষ একটি সম্পর্ক মর্যাদা থাকার বিষয়টি সুস্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছিল আমরা যখন বিভিন্ন জেলার তাবু তাবু ঘুরছিলাম এবং তাদের সাথে সাক্ষাত করে করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার দাওয়াত দিচ্ছিলাম তখন পার্থক্যটা আরো বেশী স্পষ্ট হচ্ছিল আমি ব্যক্তিগত ভাবে অনুসন্ধিৎসু ছিলাম বিধায় সম্বন্ধে আরো জানার চেষ্টা করছিলাম

দরবারের মাদরাসার একটি কক্ষে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয় ছাত্রদের সাথে আমাদের বিশেষ একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে তাদের থেকে জানতে পারি যে,

০১. হুজুর আল্লামা মাসুম শাহ রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি তাঁকে খুব স্নেহ করেন ইহার কারণ হলো- তিনি একজন বড় মাপের আলেম শরীয়ত এবং ত্বরীকত উভয় বিষয়ে তার অঘাধ পান্ডিত্য রয়েছে পবিত্র হাদীস এবং ইলমে ফিকহের উপর তাঁর মা'লুমাত বেশী ত্বরীকতের তত্ত্ব রহস্য এবং ধাপ- উপধাপে তাঁর বিচরণ হুজুর মুবারককে মোহিত করেছে ফানা ফিশ শায়খ হুজুর আল্লামা সায়্যিদ মুহাম্মদ ইসলাম শাহ চাটগামী রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহির কলিজার টুকরা হওয়ায় তাঁর প্রতি আলাদা একটি আকর্ষণ ছিল

০২. হুজুর আল্লামা মাসুম শাহ রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি বৰ্তমান চাটগামী হুজুর মুবারককে বাদশাহ হিসাবে সম্বোধন করতেন শুধু তাই নয়- ‘আমার বাদশাহ' বলতেন আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী এটাকে এজাফতে তাশরীফ বলে একান্ত আপন এবং প্রিয় বস্তুকে নিজের দিকে সম্বোধন করে তাঁর ইয্যত সম্মানকে সকলের সামনে তুলে ধরা হয় তিনি বলতেন, আমার বাদশাহ দুনিয়া এবং আখিরাতের বাদশাহ

০৩. মূল দরবারের শায়খে মুহাক্কাক যখন তাঁর খলিফাকে বিশেষ নজরে দেখেন তখন ভাবতে হবে যে, সে খলিফার বিশেষ গুণ, এলম, মর্যাদা এবং ত্বরীকতের পদোন্নতিতে তিনি সকলের সেরা এবং শ্রেষ্ঠ তার প্রতি পীরে মুহাক্কাকের বিশেষ স্বপ্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে ত্বরীকতের ভাষায় ইহাকে ইশারা

বলা হয়

০৪. বর্তমান চাটগামী হুজুরের এলমী পায়া তথা শরয়ী জ্ঞানের পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে তার উস্তাদদের মুখে মুখে ছিল জ্ঞানে গুণে চরিত্রের অনুপমতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় মনে হয়েছিল তাঁর আব্বাজান কেবলা তাঁকে ত্বরীকতের খেদমতের লক্ষ্যে তৈরী করছিলেন

০৫. এযাবৎ খুলনার দরবার শরীফের যারা খেদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছিলেন তারা সকলে জগতখ্যাত

 

আলেম ছিলেন আলেম থাকার কারণে খুলনা দরবার শরীফের কোন স্তরে কোন প্রকারের অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার এবং শরিয়ত পরিপন্থি কার্যকলাপ অনুপ্রবেশ করতে পারেনি সেখানে সবসময় সুন্নাত শরীয়াত মোতাবেক সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে

০৬. সর্বশেষ সর্বসম্মত জানশীন হযরত মাসুম খুলনবী (রহ.) চট্টগ্রাম সফর শেষে বটতলী রেলষ্টেশনে মাওলানা জয়নাল আবেদীনকে দিয়ে ঘোষণা করিয়ে দেন যে, হযরত ইসলাম শাহ ধর্মপুরী রাহমাতুল্লাহি জায়গায় তাঁরই সুযোগ্য সন্তান হযরত মাওলানা আবদুশ শাকুর রায়হান আযিযী (.জি..), স্থলাভিষিক্ত হবেন এবং সকলকে তাঁর পিতার ন্যায় তাকেও মেনে চলার নির্দেশ প্রদান করেন কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেন- তার এমন হিম্মত যোগ্যতা রয়েছে যে, তিনি কখনো বাতিলের সাথে আপোষ করবেন না ত্বরীকত দরবারের স্বার্থ স্বকীয়তা রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারবেন

ইহার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো কয়েক বৎসর পূর্বে জমিয়াতুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ মাঠে বিশাল সুন্নী সমাবেশে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা মুফতি ওবায়দুল হক নঈমী (.জি..) তার ওয়াজের মাঝে খুলনা দরবার শরীফকে উদ্দেশ্যে করে সামান্য উপেক্ষার সুরে কথা বলেছিলেন সাথে সাথে বর্তমান চাটগামী হুজুর মোবারক দাঁড়িয়ে জোরালো ভাষায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের স্বার্থে খুলনা দরবার শরীফের অবদান ত্যাগ এবং এই দরবারের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্বন্ধে দীর্ঘক্ষণ বক্তব্য রাখেন এবং নঈমী সাহেবের বক্তৃতার প্রতিবাদ করেন বাস্তবেই দেখা যাচ্ছে যে, চট্টগ্রামের সকল খুলনবী ভাইরা আকীদা, আমলে, ত্যাগ এবং পরিশ্রমে, সুন্নিয়তের ময়দানে সবসময় সোচ্ছার উচ্চকণ্ঠী বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ইসলামী ছাত্রসেনার রাজনীতিতে তারা বেশী ভূমিকা পালন করছে নাস্তিক ব্লগার মুরতাদদের তান্ডবেও তারা প্রতিবাদী ছিলেন বাতিল ইসলাম বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে সদা ভূমিকা রেখে আসছেন

০৭. কক্সবাজার জেলা পূর্ব-দক্ষিণ সীমান্তের অঞ্চল গুলোতে বলতে গেলে বাতিলদের তৎপরতা বেশী বর্তমান চাটগামী হুজুর প্রতিবৎসর সেখানে দীর্ঘ সফর করেন পাড়ায় মহল্লায় কমিটি করে দিয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতকে চিরজীবিত করে রেখেছেন

 

আর সেসব জায়গার খুলনবী ভাইরা রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ইসলামী ছাত্র সেনার রাজনীতি নিয়ে সেখানে মাঠ মাতিয়ে রেখেছেন

০৮. কর্ণফুলী ব্রিজ হওয়ার আগে কর্ণফুলী নদীর উপকূলীয় এলাকাগুলোতে হযরত মাসুম খুলনবী হুজুর মোবারককে সাম্পান যোগে অপরিসীম কষ্ট স্বীকার করে ডোর টু-ডোর সফর করতে দেখেছি সাথে থাকতেন বর্তমান চাটগামী হুজুর মোবারক এভাবে তারা সুন্নিয়ত ত্বরীকতের সেবা প্রদান করেছেন ফল হলো- অঞ্চল গুলোতে এখনো বাতিল আক্বীদার কোন লোক নাই

০৯. হযরত মাসুম খুলনবী হুজুর মোবারক যখন বর্তমান চাটগামী হুজুর মোবারককে খেলাফত প্রদান করেন তখন থেকে ত্বরীকত সুন্নীয়তের প্রচার প্রসারকে নিজের উপর ওয়াজিব করে নিয়েছেন তিনি ত্বরীকতের বাইরে বৃহৎ সুন্নিয়তকে নিয়ে ভাবতেন যার কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের যেকোন সময়ের ডাকে সাড়া দিয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় ভূমিকা রেখেছেন তার সকল অনুসারীকে বৃহত্তর সুন্নিয়তের লক্ষ্যে কাজ করতে বলেছেন সুন্নিয়তের রাজনীতির ময়দানে এই ত্বরীকার লোকদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মত লক্ষ্য করা যায়

১০. প্রকৃত আউলিআল্লাহগণ উদার এবং বিশাল হৃদয়ের অধিকারী হন তাঁরা মানবিক দূর্বলতা, পরনিন্দা, পরচর্চা, মিথ্যা এবং অপবাদ রটনা থেকে মুক্ত থাকেন তাদের লক্ষ্য হলো - মানুষকে আল্লাহওয়ালা বানানো এবং জান্নাতী হিসাবে গড়ে তোলা তাদের কাজের পরিধি যখন বৃদ্ধি পায় তখন তারা বিভিন্ন জায়গায় খলিফা নিয়োগ করেন সে খলিফারা তাদের ন্যায় পরিচ্ছন্ন মানসিকতার হয়ে থাকেন খলীফাগণ নিয়োগকর্তা পীর-মুর্শিদের আদর্শ উদ্দেশ্য ঠিক রেখে দরবারের হয়ে মানুষ কে আল্লাহওয়ালা বানান

দেখা যাচ্ছে যে, গাউছে খুলনবী হযরত আবদুল আযীয হুজুর মোবারক রাহমাতুল্লাহি তায়ালা আলাইহি পাক ভারত উপমহাদেশে তার হয়ে কাজ করার জন্য ছয়জন মনিষীকে খেলাফত প্রদান করেন তারা হলেন- ০১. মৌলভী আবদুশ শকুর, জেলা আকিয়াব, বরমা, ০২. মৌলভী নইম উদ্দীন এলাহাবাদী, ০৩ মৌলভী আলীমুদ্দীন উড়াহর; জেলা মুর্শিদাবাদ, ভারত, ০৪. মৌলভী মুহাম্মদ ইসলাম শাহ ধর্মপুরী, চাঁটগামী, ০৫. সৈয়দ মাহমুদ হাসান এলাহাবাদী, এজাজ কলোনী, লাসবিলাহ হাউস, করাচী, পাকিস্তান,

 

০৬. মৌলভী মুখলেসুর রহমান আকিয়াব, বার্মা উল্লেখ্য যে, ৫ম নং খলিফা যিনি করাচির সৈয়দ সাহেব হুজুর হিসাবে সবার কাছে পরিচিত অন্যদিকে তিনি ছিলেন হযরত মাসুম খুলনবী (রহ.) এর সম্মানিত শ্বশুর তিনি উর্দু ভাষাতে গাউছে খুলনবীর মানকাবাতের উপর গ্রন্থ রচনা করেন আশ্চর্য্য হলেও সত্য যে লেখার জন্য তাঁকে উৎসাহ দিয়েছেন- বর্তমান চাটগামী হুজুর সায়্যিদ মাওলানা আবদুশ শকুর আযিযী নকশবন্দী (.জি..) উক্ত গ্রন্থে সায়্যিদ সাহেব হুজুর তাঁকে ইসলাম শাহ ধর্মপুরী (রহ.) এরস্থলাভিষিক্ত খলিফাসম্বোধন করেছেন শোকরিয়ার বিষয় হলো গাউছে খুলনবীর খলীফা যাকে প্রথম চাটগামী হুজুরের স্থলাভিষক্ত খলীফা লিখেছেন সেটা হজরত খুলনবীগণের জন্য অনেক বড়

নেআমত

১১. খুলনা এবং খুলনার সাব ষ্টেশন চট্টগ্রামের ধর্মপুর দরবার শরীফ যে হক সত্য তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হলো- ত্বরীকার সকল মাশায়েখে এজাম আলেম এবং এলমে শরিয়তের ধারক বাহক ইহার মুরীদের মধ্যে অনেক বড় বড় জ্ঞানী আলেম, ওলামা রয়েছে

আলেম ওলামা যদি দরবারের হাল ধরেন তাহলে সে দরবার যেমন আল্লাহর দরবারে মাকবুল ঠিক তেমনি কোন রকমের শরিয়তবিরোধী কার্যকলাপ দৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকেনা শরিয়তের মাসআলা হলো একজন আলেম আরেকজন সাধারণ শিক্ষিত থাকলে সেখানে নামাযের জামাতের ইমামতের জন্যে আলেমই উপর্যুক্ত বিবেচিত হবেন এভাবে শরীয়তের প্রত্যেক কাজে আলেম ওলামাগণ অগ্রাধিকার বিবেচিত হন বিশেষ করে তরীকতের ন্যায় সূক্ষ্ম বিষয়ের দায়িত্ব পালন করার জন্য আলেম হওয়া অপরিহার্য বাংলাদেশের কতেক দরবার গুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ঢোল, তবলা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলা মেশা, সিজদা, অপ্রয়োজনে মোমবাতি জ্বালানো এবং আরো বিভিন্ন অপচয় অপকর্ম সেখানে চালু হয়েছে সেখানের সাজ্জাদানশীনরা আলেম না হওয়ার কারণে তাই দরবারকে সুন্নাত মোতাবেক রাখতে আলেমের হাতে দায়িত্ব থাকতে হবে

প্রভাষক: ছোবহানিয়া আলিয়া কামিল (এম.) মাদরাসা, চট্টগ্রাম

No comments

Powered by Blogger.