পবিত্র জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) ও ছিলছিলায়ে আলিয়া নকশবন্দিয়া মুজাদ্দেদীয়া



মাওলানা আ.ন.ম. আহমদ রেজা নকশবন্দী
জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)। এটা প্রথমে মহান আল্লাহ তায়ালা আরশ মোয়াল্লাতে করেছিল যা কোরআনে পাকে সূরা আল-ইমরানের ৮১নং আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। বিশ্ব নবী (দ.) এর আগমনে আসমানের ফেরশতারা জীবরাঈল (আ.) নেতৃত্বে করেছিল, যা অসংখ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আমাদের প্রিয় নবী মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় মদিনাবাসীরা সকলে রাস্তায় নেমে ছালাত ও ছালামের মাধ্যমে নবীর আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিল। বিশেষ করে মদিনায়ে তৈয়বার ছেলেরা নি¤œ লিখিত কবিতা পড়ে পড়ে স্বাগত জানান

এরই ধারাবাহিকতায় সমগ্র বিশ্বে আশেকে রাসুলগণ এ বিশ্বনবীর আগমনকে কেন্দ্র করে বিশাল উৎসাহ-উদ্দীপনা ভক্তি-শ্রদ্ধাসহকারে জশনে জুলুছে পালন করতে থাকেন। এশিয়া মহাদেশের সর্বজনস্বীকৃত দরবার হল দিল্লীর শাহী দরবার শরীফ। যে দরবার হতে বিশ্ব বরেণ্য অলি, গওছ, কুতুব, আবদাল ফয়েজপ্রাপ্ত হয়ে বিশ্বের আনাচে-কানাচে দ্বীন-ধর্ম ইসলামের খেদমত করে যাচ্ছে।

গওছুল আজম দেহলভী (রহ.) যিনি ফায়েজে ইত্তেহাদীর ধারক-বাহক ছিলেন, যার রূহানী সন্তানেরা প্রত্যেকই যুগ শ্রেষ্ট কামেল অলি, হযরত শাহ আয়ুল খাইর আব্দুল্লাহ মুহিউদ্দিন দেহলভী (রহ.) (জন্ম ২৭ রবিউল আখের ২৯ জামাদিউল আখের ১৩৪১ হিজরী, ১ ফেব্রæয়ারী ১৯৩২ সাল জুমাবার) প্রতি বছর তার মুরিদানদেরকে নিয়ে দিল্লী শহরের বিভিন্ন অলি গলিতে ঘোড়ার গাড়ি সাজিয়ে রাস্তা-ঘাট সহ সকল এলাকাকে শ্লোগানের মাধ্যমে মুখরিত করে জুলুছ করতেন। সে সময় মাহফিলে মোবারকে মিলাদ শরীফের বেয়াদবী করে অনেক মৌলভীরা অবশ্য রোগে ভুগলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর উক্ত দরবারের গদিনশীন হযরত শাহ আবুল হাসান যায়েদ ফারুকী (রহ.) এর কাছে সে যুগের মিলাদুন্নবী মাহফিল, জুলুছ বিরোধীরা ফতোয়া তালাশ করলেন। নি¤েœ জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) এর ব্যানারে কালজয়ী ফতোয়ার হুবহু অনুবাদ উল্লেখ করা হল। (তথ্য সূত্র মকামাতে খাইর ও তাকবিয়াতুল ঈমান আওর ইসমাইল দেহলভী। কৃত আবুল হাসান যায়েদ ফারুকী আযহারী রহ.)
শায়খুল তরিকত হযরত শাহ আবুল হাসান যায়েদ ফারুকী আযহারী (রহ.) কর্তৃক
শরয়ী ফায়সালা
ওলামায়ে দ্বীন এ মুফতিয়ানে শরয়ে মতিন এ প্রসংগে কি বলেন:-
আঁ হযরত সরদারে দোয়া আলম শফিউল মুযনেবীন রাহমাতুল লিল আলামিন সাইয়েদুনা এ ওয়া সাইয়্যেদ আউলাদে বনি আদম হযরত মুহাম্মদ (দ.) পবিত্র জন্মদিন ১২ রবিউল আউয়ালে কিছু লোক আনন্দ প্রকাশের জন্য জুলুছ বের করেন যার মধ্যে কিছুলোক না’তে রাসুল (দ.) দরুদ-সালাম এবং মোনাজাত পড়তে পড়তে মিছিলের সংগে চলতে থাকেন। আর কিছু লোক আরবী লেবাছে উটের উপর, আবার অনেকে ঘোড়ার উপর চড়ে যায়। অপরদিকে আয়োজকরা মুসলমানদের এই মর্মে উৎসাহ প্রদান করে যে, আজকের দিনে আনন্দ প্রকাশ কর আলোকসজ্জা কর ফকির মিছকিনদের মধ্যে দান খায়রাত কর। এ মাসয়ালাতে জনাব আপনার মতামত কি? এটা কি শরিয়ত বিরোধী কাজ, না কি বিদআ’ত? আর যদি বিদআ’ত হয় তাহলে এটা বিদআতে হাসানা,না গায়রে হাসনা?
এ অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করার কারণে কি কোন গোনাহ হবে এবং আমাদের ইমামগণ কি এ কাজ হতে বিরত থাকতে বলেছেন? মেহরবানী করে ফিকাহ করবেন। বড় মেহেরবানী হবে।

প্রশ্নকারীগণ
সৈয়দ এরশাদ আলী,যুবাইর আহমদ, হাজী ছাইদ, সৈয়দ ইশতিয়াক আলী, মাহবুবশাহ, শরীফ মালিশ ওয়ালে ত্বাহেরুল হাসান, শাহ কমরুদ্দিন আকরম কাদেরী, মির্জা ওসমান আযাদ, হকিম আবুল ফতাহ, সৈয়দ ইমতিয়াজ আলী এবং মৌলনা নওয়াব উদ্দিন।
তা: ৩ রবিউল আউয়াল ১৩৯৮ হিজরী, ১১হিজরী, ১ ফেব্রæয়ারী ১৯৭৮ সাল, শনিবার।
(উত্তরএবং আল্লাহ তায়ালা সঠিক কাজের পথ প্রদর্শক) সরদারে দো আলম (দ.) এর বিলাদতে সায়াদাত শরীফের দিনটি আল্লাহ তা’য়ালা কামালাতের প্রকাশ করার জন্য শ্রেষ্ট দিন। মুসলমানরা যা কিছু দ্বীনি এবং দুনিয়াবী সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছে তা এ পবিত্র ইসলামী জগতের জন্য আনন্দ, উল্লাস ও খুশির দিন। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন-

অর্থ:  অবশ্যই আল্লঅহ তায়ালা ইমানদারদের উপর ইহসান করেছেন এভাবে যে, তাঁদের মধ্যে হতে তাদের রাসুলকে পাঠিয়েছেন। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং-১৬৪)
আল্লাহ তা’য়ালা আরো ইরশাদ করেছেন-

অর্থ: হে রাসুল আপনি বলুন! আল্লঅহ তায়ালার অনুগ্রহ এবং তার রহমতের জন্য তাদের উল্লাসিত হওয়া উচিৎ। (৫৮ আয়াতংশ সুরা ইউনুচ)

রাসুলুল্লাহ (দ.) আপাদমস্তক আল্লাহ তায়ালার ফজল ও রহমত। এ আয়াতের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা তার ফজল ও রহমতের উপর আনন্দ প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। মুসলমানদের জন্য এটা সৌভাগ্যের ব্যাপার যে,তারা যেন এ মোবারক দিনে তাদের আনন্দ প্রকাশ করে।

আনন্দ প্রকাশের জন্য ঐ সমস্ত পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে যার মধ্যে শরীয়ত মোতাবেক কোন নোংরামী নেই। রাসূলে পাক (দ.) এরশাদ করেছেন যে, দুনিয়াবী কাজ কর্ম সম্পর্কে তোমরা যথেষ্ট অবগত। তাই এ প্রসংগে আলেমদের কাছে জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজন নেই। তবে অবশ্যই এতটুকু খেয়াল রাখা দরকার যে, কোন শরীয়ত বিরোধী কাজ যে তাতে কোনক্রমেই প্রবেশ না করে। উদাহরণস্বরূপ আশ্লীল নাচ-গান,মদপানসহ বিভিন্ন রকমের শরিয়তবিরোধী কার্যক্রম।
এ ধরনের মোবাহ কাজে শরয়ী বিদআ’ত গায়বে বিদআ’ত এবং পাপ ও পূণ্যের কোন প্রশ্নই আসেনা। কেউ কোন শিশুকে ঘোড়ার উপর বসিয়ে ঘুরায়, কেউ কেউ কাউকে দুলহা তথা নতুন বর সাজিয়ে গাড়িতে করে ঘোরাফিরা করে, কেউ ফুল ছড়ায়, কেউ টাকা বিতরণ করে। এছাড়া এর মধ্যে কোন রকমের নোংরামী নেই।

যদি ফুযুল খরচের কোন পন্থা সেখানে না থাকে তাহলে বিদআ’ত ও গায়রে বিদআ’তের তর্ক সেখানে অকার্যকর ও বেকার। হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রা.) এর নিকট এক আনছারী মেয়ে ছিল। তিনি মেয়েটির বিয়ে তাঁর কোন এক আত্মীয়ের সাথে দিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন যে, রাসুলে পাক (দ.) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি মেয়েটিকে সাজিয়ে দিয়েছ? উত্তরে হ্যাঁ বলা হল। তিনি এরপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কোন গায়ককে তার সঙ্গে পাঠিয়েছ? হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রা.) উত্তর করলেন না। তিনি এরশাদ করলেন আনসারদের ভাই বন্ধুরা গজল পছন্দ করে। যদি তুমি মেয়েটার সঙ্গে কাউকে পাঠিয়ে দিতে তাহলে যে আতাইনাকুম আতাইনাকুম ফাহাইয়ানা অতাইয়াকুম পড়তে তার সাথে যেতো। (মেশকাত শরীফ)
এ কাজটি ছিল মুবাহ এবং মদিনাবাসীদের মধ্যে এর চালচলন বা প্রধা ছিল এবং এটা আনন্দ প্রকাশের একটা পন্থা ছিল। রাসুলে পাক (দ.) এটাকে চালু রাখলেন এবং ছওয়াব ও আযাবের যাচাই বাছাই করলেন না।
হুজুরে কায়েনাত সরকারে দো আলম (দ.) এর শুভ জন্মদিনের মোবারক সুযোগ এতটুকু অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, আনন্দ ও উল্লাসের কারণ সেই মোবারক যাতের যাঁর আলোচনাকে রব্বুল ইজ্জত বিরাট মর্যাদা দিয়েছেন।
যেমন কোরআনের এরশাদ:

অর্থ: হে হাবিব! আমি আপনার যিকর বা আলোচনাকে সুউচ্চ বা মর্যাদাসম্পন্ন করেছি। (সুরা-ইনশাল্লাহ, আয়াত নং-৪)
আম্বিয়া হোক বা ফেরেশতা হোক সকলের নিকট আপনার নাম মোবারক অনেক উপর। সবার চেয়ে আপনার আলোচনা মর্যাদাপূর্ণ বা সম্মানজনক। এ পবিত্র উৎসবের ব্যবস্থাপকদের উচিৎ যে, এ উন্নতমানের আলোচনা যে তাদের কর্মেও প্রতিফলিত হয়, কারো মুখে দরূদ শরীফ চালু থাকবে, কেউবা আক্বিদাত এবং মোহাব্বতের মুক্ত। নিজের চোখ দিয়ে বর্ষণ করবে।
ওহে সৌভাগ্যবানরা! আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের শক্তি সামর্থ দান করুক, যেন তোমরা তাঁর হাবিব (দ.)  এর পবিত্র নামকে অত্যন্ত মর্যাদা প্রদান করবে, তাঁর পবিত্র মিলাদে মন খুলে আলোচনা কর আর এ কথার প্রতি সচেষ্ট হও যে, এ মোবারক দিনের আনন্দে আমাদের হুকুমত (সরকার)ও যেন শরীক হয় এবং এ দিনের সমগ্র হিন্দুস্থানে আনন্দের দিন হিসেবে গ্রহণ করে সরকারী ছুটি ঘোষণা করো।

মুফতি 
হযরত যায়েদ আবুল হাসান ফারুকী (রহ.)
দরগাহ হযরত শাহ আবুল খায়ের, শাহ আবুল খায়ের মার্গ, দিল্লী-৬
৫ রবিউল আউয়াল ১৩৯৮ হিজরী
সোমবার ১৩ ফেব্রæয়ারী,১৯৭৮ খ্রি।

প্রকাশিত: মাসিক আর-রায়হান, ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) সংখ্যা। রবিউল আওয়াল ১৪৩৬ হিজরী, জানুয়ারী-২০১৫খ্রি।

No comments

Powered by Blogger.