হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি রহঃ এর মোবারক জীবনী (পর্ব-২)
নকশবন্দিয়া তরিকা হাসিল -
ইমামে রাব্বানী মোজাদ্দেদ আলফে সানী (রহ:)-এর মনে আগে থেকেই বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্জ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের রওযা পাকের যিয়ারত করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অসুস্থ ও বৃদ্ধ পিতার খিদমতের জন্য তিনি হজ্জ আদায় করতে পারেননি।হিজরী ১০০৭ সালে তাঁর বুজর্গ পিতার ইনতিকালের পর তিনি ঐ বছরই হজ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে দিল্লীতে উপনীত হন। এ সময় তাঁর বন্ধু ও খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ:) - এর মুরীদ মাওলানা হাসান কাশ্মীরীর সাথে তার দেখা হয়। এ সময় মাওলানা সাহেব তাঁর নিকট হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ:) -এর কামালাতের বিষয় প্রকাশ করে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য তাঁকে উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন-
খাজা সাহেব নকশবন্দীয়া তরীকার একজন অতুলনীয় রত্ন, এ রকম লোক বর্তমানে দুর্লভ। তাঁর একটি নেক-নজরে তালেবগণ এমনই ফয়েয লাভ করেন, যা দীর্ঘদিন সাধনা ও চিল্লার দ্বারা হাসিল হয় না।
ইতিপূর্বে হযরত মোজাদ্দেদ (রহ:) এই তরীকা সম্পর্কে তাঁর বুজর্গ পিতার নিকট থেকে বহু কিছু শুনে এবং বইপত্র পড়ে অবগত হয়েছিলেন, এবং এই তরীকার প্রতি তাঁর স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকায় তিনি দেরী না করে তখনই মাওলানা হাসান সাহেবের সাথে খাজা সাহেবের দরবারে হাযির হন। কার ও প্রতি কোনরূপ আগ্রহ প্রকাশ করার অভ্যাস হযরত খাজা (রহ:)-এর ছিলনা। তা সত্বেও তিনি তাঁর আদতের খিলাফ করে হযরত মোজাদ্দেদ (রহ:) কে কিছুদিন তাঁর খানকায় থাকার জন্য অনুরোধ করেন । তিনি সেখানে এক সপ্তাহ থাকবেন বলে ওয়াদা করলেও, প্রায় আড়াই মাস হযরত খাজার দরবারে অবস্থান করেন। দু’দিনের মধ্যে তিনি নিজের মধ্যে হযরত খাজার প্রভাব উপলব্ধি করে বায়আত হওয়ার দরখাস্ত পেশ করেন। ফলে, খাজা সাহেব সাথে সাথেই তাকে বায়আত করে ‘ক্বলবে’ যিকিরের তালিম দেন এবং তাঁর ‘ক্বলব’ তখনই জারী হয়ে যায়।
ইমামে রাব্বানী মোজাদ্দেদ আলফে সানী (রহ:)-এর মনে আগে থেকেই বায়তুল্লাহ শরীফের হজ্জ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের রওযা পাকের যিয়ারত করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু অসুস্থ ও বৃদ্ধ পিতার খিদমতের জন্য তিনি হজ্জ আদায় করতে পারেননি।হিজরী ১০০৭ সালে তাঁর বুজর্গ পিতার ইনতিকালের পর তিনি ঐ বছরই হজ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে দিল্লীতে উপনীত হন। এ সময় তাঁর বন্ধু ও খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ:) - এর মুরীদ মাওলানা হাসান কাশ্মীরীর সাথে তার দেখা হয়। এ সময় মাওলানা সাহেব তাঁর নিকট হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ:) -এর কামালাতের বিষয় প্রকাশ করে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য তাঁকে উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন-
খাজা সাহেব নকশবন্দীয়া তরীকার একজন অতুলনীয় রত্ন, এ রকম লোক বর্তমানে দুর্লভ। তাঁর একটি নেক-নজরে তালেবগণ এমনই ফয়েয লাভ করেন, যা দীর্ঘদিন সাধনা ও চিল্লার দ্বারা হাসিল হয় না।
ইতিপূর্বে হযরত মোজাদ্দেদ (রহ:) এই তরীকা সম্পর্কে তাঁর বুজর্গ পিতার নিকট থেকে বহু কিছু শুনে এবং বইপত্র পড়ে অবগত হয়েছিলেন, এবং এই তরীকার প্রতি তাঁর স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকায় তিনি দেরী না করে তখনই মাওলানা হাসান সাহেবের সাথে খাজা সাহেবের দরবারে হাযির হন। কার ও প্রতি কোনরূপ আগ্রহ প্রকাশ করার অভ্যাস হযরত খাজা (রহ:)-এর ছিলনা। তা সত্বেও তিনি তাঁর আদতের খিলাফ করে হযরত মোজাদ্দেদ (রহ:) কে কিছুদিন তাঁর খানকায় থাকার জন্য অনুরোধ করেন । তিনি সেখানে এক সপ্তাহ থাকবেন বলে ওয়াদা করলেও, প্রায় আড়াই মাস হযরত খাজার দরবারে অবস্থান করেন। দু’দিনের মধ্যে তিনি নিজের মধ্যে হযরত খাজার প্রভাব উপলব্ধি করে বায়আত হওয়ার দরখাস্ত পেশ করেন। ফলে, খাজা সাহেব সাথে সাথেই তাকে বায়আত করে ‘ক্বলবে’ যিকিরের তালিম দেন এবং তাঁর ‘ক্বলব’ তখনই জারী হয়ে যায়।
খিলাফত লাভ -
হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ:) হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ:)-এর ন্যায় একজন সুযোগ্য মুরীদের তালিম ও তারবিয়তের মাধ্যমে কামালিয়াতের দরজায় পৌঁছানোর সুযোগ পাওয়ায় আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন। তিনি তাঁর কামালাত ও হালাতের প্রশংসা করে এক মুবারক সময়ে তার খিলাফাতের ‘খেলাতে’ বা মর্যাদায় বিভূষিত করেন এবং পরে সিরহিন্দ শরীফে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
ইমামে রাব্বানী, মোজাদ্দেদ আলফে সানী (রহ:) নিজ জন্মভূমি সিরহিন্দ শরীফে ফিরে আসার পর নিজ বুজর্গ মুর্শিদের হিদায়েত ও ইরশাদ বা নির্দেশ অনুযায়ী তালেবদের বা ইলমে মারিফাত অনুসন্ধানকারীদের শিক্ষা-দীক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ফলে অতি অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শত শত তালেবে মারিফাত বা মারিফাত অন্বেষণকারীরা দুনিয়া ও আখিরাতের চিরকল্যাণ লাভ করে ধন্য হয়।
হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ:) হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ:)-এর ন্যায় একজন সুযোগ্য মুরীদের তালিম ও তারবিয়তের মাধ্যমে কামালিয়াতের দরজায় পৌঁছানোর সুযোগ পাওয়ায় আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন। তিনি তাঁর কামালাত ও হালাতের প্রশংসা করে এক মুবারক সময়ে তার খিলাফাতের ‘খেলাতে’ বা মর্যাদায় বিভূষিত করেন এবং পরে সিরহিন্দ শরীফে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
ইমামে রাব্বানী, মোজাদ্দেদ আলফে সানী (রহ:) নিজ জন্মভূমি সিরহিন্দ শরীফে ফিরে আসার পর নিজ বুজর্গ মুর্শিদের হিদায়েত ও ইরশাদ বা নির্দেশ অনুযায়ী তালেবদের বা ইলমে মারিফাত অনুসন্ধানকারীদের শিক্ষা-দীক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ফলে অতি অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শত শত তালেবে মারিফাত বা মারিফাত অন্বেষণকারীরা দুনিয়া ও আখিরাতের চিরকল্যাণ লাভ করে ধন্য হয়।
মোজাদ্দেদ উপাধি লাভ -
হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ:) তাঁর মুর্শিদের নির্দেশে সিরহিন্দ শরীফে ফিরে আসলে দলে দলে লোক তাঁর খিদমতে হাযির হয়ে বায়আত হতে থাকে। এসময় একদিন তিনি ফজরের নামাযের পর তাঁর হুজরায় মুরাকাবায় মশগুল থাকা অবস্থায় দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম রুহানীভাবে সমস্ত আম্বিয়া, অসংখ্য ফেরেশতা আউলিয়া ও গাওস কুতুবদের সাথে সেখানে তাশরীফ এনেছেন। নবী করীম (স.) তাঁর পবিত্র হাতে শায়খ আহমদ (রহ:)কে একটি অমূল্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পোশাক পরিয়ে দিয়ে বলেনঃ
শায়খ আহমাদ মোজাদ্দেদের প্রতীকস্বরূপ আমি তোমাকে এই ‘খিলআত’ বা পোশাক পরিয়ে দিলাম এবং দ্বিতীয় হাজার বছরের জন্য আমি তোমাকে আমার বিশেষ প্রতিনিধি মনোনীত করলাম। আমার উম্মাতের দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় দায়িত্ব আজ হতে তোমার উপর অর্পিত হলো।
উল্লেখ্য যে, এই ঘটনাটি ১০১০ হিজরীর ১০ই রবিউল আউয়াল শুক্রবার ফযরের নামাযের সময় সংঘটিত হয়। নবী রাসূলগণ সাধারণতঃ যে বয়সে নবূওতের দায়িত্ব প্রাপ্ত হতেন, সেই বয়সে অর্থাৎ চল্লিশ বছর বয়সের সময় হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) “ মোজাদ্দেদ আলফ সানী ” উপাধিতে ভূষিত হন।
মোজাদ্দেদ আলফে সানী (রহ.) এ সম্পর্কে বলেনঃ
আমার উপর মোজাদ্দেদীয়াত বা সংস্কারকের দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে, শুধু পীর-মুরিদি করার জন্য আমাকে প্রেরণ করা হয় নি । মুরীদদের মারিফাতের বা আল্লাহ্ প্রাপ্তির তালিম দেয়া আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। যে মহান দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে, তা অনেক ব্যাপক ও বড়। মুরীদদের তরীকতের তালিম বা শিক্ষা দেয়া এবং মানুষকে কামালিয়াত বা পূর্ণতার স্তরে পৌঁছানো রাস্তা থেকে কুড়ানো তুচ্ছ জিনিসের মত।
— শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ.), মাকতূবাতে ইমামে রাব্বানী, ২য় খন্ড, মাকতূব নং- ৬ দ্রষ্টব্য
‘মোজাদ্দেদ’ আরবী শব্দ। এর অর্থঃ দ্বীনের সংস্কারক। মানুষ যখন ধর্ম বিমুখ হয়ে স্বেচ্ছাচারিতা ও শয়তানের পায়রবী শুরু করে, নৈতিক ও জাতীয় জীবন হয় কলুষিত, তখন তাদের হিদায়েতের প্রয়োজনে আল্লাহ্ তায়ালা বিশেষ দায়িত্ব সহকারে তাঁর তরফ থেকে প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। এটাই চিরন্তন রীতি। নবূওত ও রিসালাতের ধারা বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যুগে যুগে তাদের আগমন ঘটেছে। তাঁরা সবাই পথহারা, গুমরাহের মানুষদের সত্যপথের সন্ধান দিয়ে গেছেন।নবূওত যেমন আল্লাহ্ তায়ালার একটি মহান দায়িত্ব, তেমনি ‘মোজাদ্দেদ’ উাপাধি প্রদান ও তাঁর আরেকটি বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা করেন, তিনিই কেবল এই মহান পদের অধিকারী হতে পারেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেনঃ
নিশ্চয় আল্লাহ্ তায়ালা এই উম্মতের হিদায়েতের জন্য প্রতি শতকে এমন এক মহান ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন, যিতি তার যুগে দ্বীনের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক হন।মোজাদ্দেদ আলফেসানি -
মোজাদ্দেদ ’ শব্দের অর্থ সংস্কারক। ‘আলফুন ’ অর্থ হাজার এবং ‘ সানী’ অর্থ দ্বিতীয়। সুতরাং “ মোজাদ্দেদ আলফে সানী ”-এ শব্দের অর্থ হচ্ছেঃ “দ্বিতীয় হাজার বছরের সংস্কারক”। তিনি শুধু শতকের ‘মোজাদ্দেদ’ ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন হাজার বছরের মোজাদ্দেদ। পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার আলোকে পরিস্কার ভাবেই উপলব্ধি করা যায় যে, ফিত্না-ফাসাদ পূর্ণ অবস্থার মধ্যে হযরত মোজাদ্দেদ আলফে সানী (রহ.) যে বৈপ্লবিক কর্মসূচী গ্রহণ করে ভারত বর্ষের তৎকালীন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনধারার সংস্কার সাধন করেছিলেন, তাই তার সংস্কারকে শত বছরের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, হাজার বছরের সংস্কার কর্মের রূপরেখায় ব্যাপ্ত করে দিয়েছে। হযরত রাসূলে করীম (স.) তাঁর উম্মতের উপর একবার পাঁচশো বছর পর, আবার এক হাজার বছর পর ভীষণ দুর্যোগ নেমে আসবে বলে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। বস্তুত তাঁর সে ভবিষ্যদ্বানী বাস্তবে রূপায়িত ও হয়।
দ্বিতীয় হাজার বছরের শুরু থেকে মুসলিম জাহানে পুনরায় দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেয়। এ সময় ইহুদী, নাসারা, মুশরিক, মুরতাদ ও মুনাফিকরা নানাভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য বদ্ধপরিকর হয় । অন্যদিকে মুসলিম সমাজের মাঝে ধর্মের নামে অধর্ম এবং পীরি-মুরীদীর নামে অনেক বিদ্‘আত ও ফাসেকী কর্মকান্ড দেখা দেয়। শিয়া-সুন্নী ও রাফেজী খারেজী ইত্যাদি উগ্র সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এক কথায়- বাইরের শত্রুর আক্রমণ এবং নিজেদের পারস্পরিক কোন্দল, স্বার্থের হানাহানি ও হীন চক্রান্তের মাঝে পড়ে মুসলমানরা অতল তলে নিমজ্জিত হতে থাকে। বিশেষত: তদানীন্তন ভারতে মুসলমানদের অবস্থা সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থায় এসে পৌঁছে । স্বেচ্ছাচারিতার উদ্যাম সয়লাবের মুখে মহানবী (স.) এর আদর্শ হেয়, লাঞ্ছিত ও পদদলিত হতে থাকে। ঠিক এমনি দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্তে হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহঃ) কে আল্লাহ্ তায়ালা মোজাদ্দেদ রূপে প্রেরণ করেন। হযরত মোজাদ্দেদ (রহঃ) আল্লাহ্ প্রদত্ত দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেন, যার ফলে এই উপ মহাদেশে মৃত প্রায় ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হয়।
উল্লেখ্য যে, হযরত মোজাদ্দেদ আলফে সানী (রহঃ) হলেন সেই মহান ব্যক্তি, যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (স.) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বানী করেন। তিনি বলেনঃ
একাদশ শতকের প্রারম্ভে মহান আল্লাহ্ দুনিয়ার বুকে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি উজ্জ্বল ‘নূর’ স্বরূপ হবেন। তার নামকরণ করা হবে আমারই নামানুষারে। দু’জন স্বেচ্ছাচারী বাদশার যুগে তাঁর আবির্ভাব হবে। তাঁর তালিম ও তরবীয়তে অসংখ্য লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে।
— মাওলানা হাসান কাশ্মী (র); রওজাতুল কাইয়ুমিয়া। পৃ. ৩৭-৩৮
উপরোক্ত হাদীসে যে দু’জন স্বেচ্ছাচারী বাদশার কথা বলা হয়েছে, তারা ছিলেন সম্রাট আকবর ও তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর। আকবরের শাসনামলে প্রকৃতপক্ষে হযরত মোজাদ্দেদ (রহঃ)-এর সংস্কারমূলক কাজ শুরু হয় এবং জাহাঙ্গীরের আমলে তা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।
হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ:) তাঁর মুর্শিদের নির্দেশে সিরহিন্দ শরীফে ফিরে আসলে দলে দলে লোক তাঁর খিদমতে হাযির হয়ে বায়আত হতে থাকে। এসময় একদিন তিনি ফজরের নামাযের পর তাঁর হুজরায় মুরাকাবায় মশগুল থাকা অবস্থায় দেখেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম রুহানীভাবে সমস্ত আম্বিয়া, অসংখ্য ফেরেশতা আউলিয়া ও গাওস কুতুবদের সাথে সেখানে তাশরীফ এনেছেন। নবী করীম (স.) তাঁর পবিত্র হাতে শায়খ আহমদ (রহ:)কে একটি অমূল্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পোশাক পরিয়ে দিয়ে বলেনঃ
শায়খ আহমাদ মোজাদ্দেদের প্রতীকস্বরূপ আমি তোমাকে এই ‘খিলআত’ বা পোশাক পরিয়ে দিলাম এবং দ্বিতীয় হাজার বছরের জন্য আমি তোমাকে আমার বিশেষ প্রতিনিধি মনোনীত করলাম। আমার উম্মাতের দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় দায়িত্ব আজ হতে তোমার উপর অর্পিত হলো।
উল্লেখ্য যে, এই ঘটনাটি ১০১০ হিজরীর ১০ই রবিউল আউয়াল শুক্রবার ফযরের নামাযের সময় সংঘটিত হয়। নবী রাসূলগণ সাধারণতঃ যে বয়সে নবূওতের দায়িত্ব প্রাপ্ত হতেন, সেই বয়সে অর্থাৎ চল্লিশ বছর বয়সের সময় হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) “ মোজাদ্দেদ আলফ সানী ” উপাধিতে ভূষিত হন।
মোজাদ্দেদ আলফে সানী (রহ.) এ সম্পর্কে বলেনঃ
আমার উপর মোজাদ্দেদীয়াত বা সংস্কারকের দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে, শুধু পীর-মুরিদি করার জন্য আমাকে প্রেরণ করা হয় নি । মুরীদদের মারিফাতের বা আল্লাহ্ প্রাপ্তির তালিম দেয়া আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। যে মহান দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে, তা অনেক ব্যাপক ও বড়। মুরীদদের তরীকতের তালিম বা শিক্ষা দেয়া এবং মানুষকে কামালিয়াত বা পূর্ণতার স্তরে পৌঁছানো রাস্তা থেকে কুড়ানো তুচ্ছ জিনিসের মত।
— শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহ.), মাকতূবাতে ইমামে রাব্বানী, ২য় খন্ড, মাকতূব নং- ৬ দ্রষ্টব্য
‘মোজাদ্দেদ’ আরবী শব্দ। এর অর্থঃ দ্বীনের সংস্কারক। মানুষ যখন ধর্ম বিমুখ হয়ে স্বেচ্ছাচারিতা ও শয়তানের পায়রবী শুরু করে, নৈতিক ও জাতীয় জীবন হয় কলুষিত, তখন তাদের হিদায়েতের প্রয়োজনে আল্লাহ্ তায়ালা বিশেষ দায়িত্ব সহকারে তাঁর তরফ থেকে প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। এটাই চিরন্তন রীতি। নবূওত ও রিসালাতের ধারা বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যুগে যুগে তাদের আগমন ঘটেছে। তাঁরা সবাই পথহারা, গুমরাহের মানুষদের সত্যপথের সন্ধান দিয়ে গেছেন।নবূওত যেমন আল্লাহ্ তায়ালার একটি মহান দায়িত্ব, তেমনি ‘মোজাদ্দেদ’ উাপাধি প্রদান ও তাঁর আরেকটি বিশেষ নিয়ামত। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা করেন, তিনিই কেবল এই মহান পদের অধিকারী হতে পারেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেনঃ
নিশ্চয় আল্লাহ্ তায়ালা এই উম্মতের হিদায়েতের জন্য প্রতি শতকে এমন এক মহান ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন, যিতি তার যুগে দ্বীনের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক হন।মোজাদ্দেদ আলফেসানি -
মোজাদ্দেদ ’ শব্দের অর্থ সংস্কারক। ‘আলফুন ’ অর্থ হাজার এবং ‘ সানী’ অর্থ দ্বিতীয়। সুতরাং “ মোজাদ্দেদ আলফে সানী ”-এ শব্দের অর্থ হচ্ছেঃ “দ্বিতীয় হাজার বছরের সংস্কারক”। তিনি শুধু শতকের ‘মোজাদ্দেদ’ ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন হাজার বছরের মোজাদ্দেদ। পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার আলোকে পরিস্কার ভাবেই উপলব্ধি করা যায় যে, ফিত্না-ফাসাদ পূর্ণ অবস্থার মধ্যে হযরত মোজাদ্দেদ আলফে সানী (রহ.) যে বৈপ্লবিক কর্মসূচী গ্রহণ করে ভারত বর্ষের তৎকালীন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনধারার সংস্কার সাধন করেছিলেন, তাই তার সংস্কারকে শত বছরের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, হাজার বছরের সংস্কার কর্মের রূপরেখায় ব্যাপ্ত করে দিয়েছে। হযরত রাসূলে করীম (স.) তাঁর উম্মতের উপর একবার পাঁচশো বছর পর, আবার এক হাজার বছর পর ভীষণ দুর্যোগ নেমে আসবে বলে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। বস্তুত তাঁর সে ভবিষ্যদ্বানী বাস্তবে রূপায়িত ও হয়।
দ্বিতীয় হাজার বছরের শুরু থেকে মুসলিম জাহানে পুনরায় দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেয়। এ সময় ইহুদী, নাসারা, মুশরিক, মুরতাদ ও মুনাফিকরা নানাভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য বদ্ধপরিকর হয় । অন্যদিকে মুসলিম সমাজের মাঝে ধর্মের নামে অধর্ম এবং পীরি-মুরীদীর নামে অনেক বিদ্‘আত ও ফাসেকী কর্মকান্ড দেখা দেয়। শিয়া-সুন্নী ও রাফেজী খারেজী ইত্যাদি উগ্র সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এক কথায়- বাইরের শত্রুর আক্রমণ এবং নিজেদের পারস্পরিক কোন্দল, স্বার্থের হানাহানি ও হীন চক্রান্তের মাঝে পড়ে মুসলমানরা অতল তলে নিমজ্জিত হতে থাকে। বিশেষত: তদানীন্তন ভারতে মুসলমানদের অবস্থা সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থায় এসে পৌঁছে । স্বেচ্ছাচারিতার উদ্যাম সয়লাবের মুখে মহানবী (স.) এর আদর্শ হেয়, লাঞ্ছিত ও পদদলিত হতে থাকে। ঠিক এমনি দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্তে হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী (রহঃ) কে আল্লাহ্ তায়ালা মোজাদ্দেদ রূপে প্রেরণ করেন। হযরত মোজাদ্দেদ (রহঃ) আল্লাহ্ প্রদত্ত দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেন, যার ফলে এই উপ মহাদেশে মৃত প্রায় ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হয়।
উল্লেখ্য যে, হযরত মোজাদ্দেদ আলফে সানী (রহঃ) হলেন সেই মহান ব্যক্তি, যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (স.) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বানী করেন। তিনি বলেনঃ
একাদশ শতকের প্রারম্ভে মহান আল্লাহ্ দুনিয়ার বুকে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি উজ্জ্বল ‘নূর’ স্বরূপ হবেন। তার নামকরণ করা হবে আমারই নামানুষারে। দু’জন স্বেচ্ছাচারী বাদশার যুগে তাঁর আবির্ভাব হবে। তাঁর তালিম ও তরবীয়তে অসংখ্য লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে।
— মাওলানা হাসান কাশ্মী (র); রওজাতুল কাইয়ুমিয়া। পৃ. ৩৭-৩৮
উপরোক্ত হাদীসে যে দু’জন স্বেচ্ছাচারী বাদশার কথা বলা হয়েছে, তারা ছিলেন সম্রাট আকবর ও তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর। আকবরের শাসনামলে প্রকৃতপক্ষে হযরত মোজাদ্দেদ (রহঃ)-এর সংস্কারমূলক কাজ শুরু হয় এবং জাহাঙ্গীরের আমলে তা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।
সম্রাট আকবরের দ্বীন ই ইলাহী -
সম্রাট আকবর ইসলাম ধর্মের পরিবর্তে নতুন এক ধর্মের প্রবর্তন করেন।ইহা ছিল স্পষ্টতই এক কুফরী ধর্ম অথচ এই নতুন ধর্মের নাম দেওয়া হলো ''দ্বীন-ই-ইলাহী''।
এই নতুন ধর্মের প্রধান উপাদান ছিল সূর্যের উপাসনা করা।তিনি তিলক লাগাতেন ও পৈতা পরতেন।সূর্যদয়ের সময় ও মধ্যরাত্রিতে নহবত ও নাকাড়া বাজান হতো।এই নতুন ধর্মে সূর্যের নাম উচ্চারনকালে 'জাল্লাত কুদরাতুহু' বলা হতো।বাদশাহ বিশ্বাস করতেন যে ,সূর্য বাদশাহ গনের অভিবাবক ও হিতাকাঙ্খী।তিনি তাই হিন্দুদের কাছ থেকে সূর্যকে বশীভূত করার মন্ত্র শিখেছিলেন।মাঝরাত্রে ও ভোরে তিনি এই মন্ত্র পাঠ করতেন।শিবরাতে তিনি যোগীদের আসরে সমস্ত রাত্রি বসে থাকতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে ,ইহাতে আয়ু বৃদ্ধী পায়।
'ব্রাক্ষ্মদান' নামক জনৈক ব্রাক্ষ্মনকে বাদশাহ রাজকবি নিযুক্ত করেন। ইতিহাসে তিনিই ''বিরবল'' নামে পরিচিত । তারই পরামর্শে 'দেবী' নামক জনৈক হিন্দু দার্শনিক বাদশাহর সহিত মেলামেশা করার সুযোগ পায়।রাত্রিকালে বাদশাহর অন্দরমহলেও এই দার্শনিকের অবাধ যাতায়াত ছিল।বাদশাহ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করার জন্য সর্বদা উদগ্রীব থাকতেন।ইহা ছাড়া এই ধর্মে আগুন,পানি,গাছ,গাভী পূজা করা হত।নক্ষত্র পূজার ব্যাপারেও বাদশাহ অত্যধিক বাড়াবাড়ি করতেন। হিন্দুদের পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করাও ছিল এই ধর্মের কর্তব্য।
হির বিজয় সূরী নামক জনৈক সাধুকে বাদশাহ 'জগৎগুরু' উপাধি দেন।
বাদশাহ জৈন সাধুদের যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।সাধু সঙ্গ লাভের পর হতে তাহার নিকট সব সময় এমনকি ভ্রমনের সময়েও একজন জৈন সাধু থাকত।''হির বিজয়সুরী'' নামক এক সাধুকে তিনি 'জগৎগুরু' উপাধী দিয়েছিলেন।নন্দা বিজয়সূরী নামক এক সাধুকে তিনি 'খশফহম' উপাধী দিয়েছিলেন। হির বিজয় সূরীকে খুশী করবার জন্য তিনি ধর্মপর্ব 'পর্যুষনে' বার দিন জীব হত্যা নিষিদ্ধ করবার ফরমান জারী করেছিলেন।জৈন ধর্ম অনুযায়ী বাদশাহ নিজেও মাংস ভক্ষন ত্যাগ করেছিলেন।অগ্নিপূজকদের দারাও বাদশাহ যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।তাহার আদেশে দরবারের সন্মুখে সর্বক্ষন অগ্নি প্রজ্জলন করবার ব্যাবস্হা করা হয়।ঘন্টাধ্বনি প্রভৃতি গ্রহন করা হয় খৃষ্টানদের নিকট থেকে।মোটকথা ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মই বাদশাহর চোখে সুন্দর মনে হত।তার চোখে সবচেয়ে সুন্দর মনে হতো হিন্দুধর্ম।তাই তার নতুন ধর্ম 'দ্বীন-ই-ইলাহির' বেশীর ভাগ উপাদানই গৃহীত হয়েছিল হিন্দুধর্ম হতে।তাই সঙ্গত কারনেই হিন্দু এবং রাজপুতদের নিকটই এই অদ্ভুত ধর্ম সমাদর লাভ করেছিল সবচাইতে বেশী।সম্ভবত বাদশাহ আকবেরর কাম্যও ছিল তাই।
দীন-ই-ইলাহির মূলমন্ত্র ছিল ''লা ইলাহা ইল্লালাহু আকবারু খলিলুল্লাহì''
দীন-ই-ইলাহির লোকেরা চিঠিপত্রের শিরোনামে 'আল্লাহ আকবর'
লিখিত এবং পরস্পরের সাক্ষাতের সময় সালামের পরিবর্তে একজন বলত
'আল্লাহ আকবর'' এবং অপরজন এর জবাবে বলত 'জাল্লাজালালুহু'।
বাদশাহ তাহাদিগকে শিজরা স্বরূপ তাহার একখানি প্রতিকৃতি প্রদান করতেন।তারা বাদশাহর এই প্রতিকৃতি পরম শ্রদ্ধাভরে নিজ নিজ পাগড়ীতে বসিয়ে রাখত।
বাদশাহ যে সব পুজাপাবন করতেন অনুসারীগনকেও সেই সব করতে হত।উপরন্তু তাদেরকে বাদশাহকেও সেজদা করতে হত।ভন্ড সূফীদের সর্দার 'তাজুল আরেফিন' বাদশাহকে সেজদা করা ওয়াজেব বলে ফতোয়া দান করেন।এই সেজদার নাম করন করা হয় 'জমিন বোছ'।তিনি বলেন বাদশাহর প্রতি সন্মান প্রদর্শন করা ফরজে আইন এবং চেহারা কেবলায়ে হাজত ও কাবায়ে মুরাদ।হিন্দুস্হানের ভ্রষ্ট সূফীদের কার্যপ্রনালী দলীলরূপে খাড়া করে তিনি এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন।সাধারন ব্যক্তিছাড়াও বিশিষ্ট আলেমগনও এই শেরেকি কার্যে অভ্যস্হ ছিলেন।
এই নুতন ধর্মে সূদ ও জুয়া ছিল হালাল।খাছ দরবারে জুয়া খেলার জন্য একটি ঘর নির্মান করা হয় এবং জুয়াড়ীদেরকে রাজকোষ থেকে সুদি কর্জ দেয়া হত।মদ্যপান করাও হালাল সাব্যস্হ করা হয়। বাদশাহ স্বয়ং দরবারের নিকট একটি শরাবখানা খুলে দেন।নওরোজ অনুষ্ঠানে অধিকাংশ আলেম,কাজী ও মুফতিগনকে শরাব পান করতে বাধ্য করা হত।
এই ধর্মে দাড়ি মুন্ডনের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হত। বাদশাহ এই ব্যাপারে রাজপুত পত্নীদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন।
নাপাকির জন্য গোসল করা ইসলামে ফরজ।কিন্তু বাদশাহ আকবরের ধর্মে এর বিপরিত মত প্রকাশ করা হয়।বলা হয় যে 'মনী' উৎকৃষ্ট মানুষ সৃষ্টির বীজ। তাই গোসল করিয়া সহবাস করাই উত্তম।যুবতী নারীদের বাধ্যতামুলকভাবে চেহারা খুলিয়া পথ চলা ছিল এই ধর্মের আইন। শহরের বাহিরে বিভিন্ন যায়গায় পতিতাদের বসতি স্হাপন করিয়া ব্যাভিচারকে আইন সঙ্গত করা হয়।পতিতালয় গুলির নাম দেয়া হয় 'শয়তানপুর'।এই সব স্হানে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্হা করা হয়। খৎনারূপ সুন্নতকে মিটাইয়া দেবার জন্য বার বৎসরের পূর্বে বালকদের খৎনা করা নিষিদ্ধ করা হয়।
গরু জবেহ করা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে দিলেন।কানুন জারী করলেন,কসাই এর সাথে কেউ আহার করলে তার হাত কেটে দেয়া হবে এমনকি তাহার স্ত্রীও যদি তাহার সাথে আহার করে তবে তার আঙ্গুল কাটা হবে।এই নুতন ধর্মে গরু,উট,ভেড়া প্রভৃতি জন্তুর গোশত হারাম বলিয়া ঘোষিত হল।পক্ষান্তরে বাঘ ভাল্লুকের গোশত হালালের মর্যাদা লাভ করে।আরবী ভাষা পড়া ও জানা অপরাধ বলে সাব্যস্হ হলো। জ্যোতিষশাস্ত্র,অংক,চিকিৎসা,ইতিহাস,ও কথা কাহিনী প্রভৃতি পুস্তকের প্রচলন করা হল। বাদশাহ আকবর হিন্দুদের উপর হতে জিজিয়া কর উঠিয়ে নিলেন।পূর্বে যারা 'এলমে ফেকাহ ' শিক্ষা দান করতেন তাদেরকে একশত বিঘাজমি জায়গীরসরূপ দেয়া হত। বাদশাহ আকবর এই জায়গা ছিনিয়ে নিলেন।ইসলামী আইন অনুযায়ী বিচার করার জন্য নিযুক্ত করা হত।জায়গীর প্রথা বন্দ্ধ করার ফলে ইসলামী বিচার ব্যবস্হার মূলে কুঠারাঘাত করা হল।এমনি করে ইসলামী হুকুমতের শেষ চিহ্ন টুকুও বিলুপ্ত করার জন্য বাদশাহ আকবর সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন।ফলে কয়েক বৎসরের মধ্যে হুকুমতের কোন ক্ষেত্রেই আর ইসলামের চিহ্ন অবশিষ্ট রইল না।মসজিদ বিরান হল।মাদ্রাসা ধ্বংস হল।মোট কথা সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বিরোধিতা করাই ছিল দিন-ই-ইলাহির মূল উদ্দেশ্য। অধিকাংশ আলেম দেশ ত্যাগে বাধ্য হল।
শেষ পর্যন্ত বাদশাহ আকবরের রাজত্বে এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্হিতির সৃষ্টি হল যাতে সুন্নি মুসলমানগন অতিষ্ট হয়ে উঠলেন।কারন একমাত্র সুন্নী মুসলমানগন ব্যতিত অন্য সব সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল বাদশাহর প্রিয়।কাফেররা সন্মানিত হল,মোসলমানগন হলেন অপদস্হ।ইসলামী আহকাম পালন করতে গিয়ে তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে কাফেরদের বিদ্রুপবানে জর্জরিত হতে লাগলেন।
সম্রাট আকবর ইসলাম ধর্মের পরিবর্তে নতুন এক ধর্মের প্রবর্তন করেন।ইহা ছিল স্পষ্টতই এক কুফরী ধর্ম অথচ এই নতুন ধর্মের নাম দেওয়া হলো ''দ্বীন-ই-ইলাহী''।
এই নতুন ধর্মের প্রধান উপাদান ছিল সূর্যের উপাসনা করা।তিনি তিলক লাগাতেন ও পৈতা পরতেন।সূর্যদয়ের সময় ও মধ্যরাত্রিতে নহবত ও নাকাড়া বাজান হতো।এই নতুন ধর্মে সূর্যের নাম উচ্চারনকালে 'জাল্লাত কুদরাতুহু' বলা হতো।বাদশাহ বিশ্বাস করতেন যে ,সূর্য বাদশাহ গনের অভিবাবক ও হিতাকাঙ্খী।তিনি তাই হিন্দুদের কাছ থেকে সূর্যকে বশীভূত করার মন্ত্র শিখেছিলেন।মাঝরাত্রে ও ভোরে তিনি এই মন্ত্র পাঠ করতেন।শিবরাতে তিনি যোগীদের আসরে সমস্ত রাত্রি বসে থাকতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে ,ইহাতে আয়ু বৃদ্ধী পায়।
'ব্রাক্ষ্মদান' নামক জনৈক ব্রাক্ষ্মনকে বাদশাহ রাজকবি নিযুক্ত করেন। ইতিহাসে তিনিই ''বিরবল'' নামে পরিচিত । তারই পরামর্শে 'দেবী' নামক জনৈক হিন্দু দার্শনিক বাদশাহর সহিত মেলামেশা করার সুযোগ পায়।রাত্রিকালে বাদশাহর অন্দরমহলেও এই দার্শনিকের অবাধ যাতায়াত ছিল।বাদশাহ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করার জন্য সর্বদা উদগ্রীব থাকতেন।ইহা ছাড়া এই ধর্মে আগুন,পানি,গাছ,গাভী পূজা করা হত।নক্ষত্র পূজার ব্যাপারেও বাদশাহ অত্যধিক বাড়াবাড়ি করতেন। হিন্দুদের পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করাও ছিল এই ধর্মের কর্তব্য।
হির বিজয় সূরী নামক জনৈক সাধুকে বাদশাহ 'জগৎগুরু' উপাধি দেন।
বাদশাহ জৈন সাধুদের যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।সাধু সঙ্গ লাভের পর হতে তাহার নিকট সব সময় এমনকি ভ্রমনের সময়েও একজন জৈন সাধু থাকত।''হির বিজয়সুরী'' নামক এক সাধুকে তিনি 'জগৎগুরু' উপাধী দিয়েছিলেন।নন্দা বিজয়সূরী নামক এক সাধুকে তিনি 'খশফহম' উপাধী দিয়েছিলেন। হির বিজয় সূরীকে খুশী করবার জন্য তিনি ধর্মপর্ব 'পর্যুষনে' বার দিন জীব হত্যা নিষিদ্ধ করবার ফরমান জারী করেছিলেন।জৈন ধর্ম অনুযায়ী বাদশাহ নিজেও মাংস ভক্ষন ত্যাগ করেছিলেন।অগ্নিপূজকদের দারাও বাদশাহ যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন।তাহার আদেশে দরবারের সন্মুখে সর্বক্ষন অগ্নি প্রজ্জলন করবার ব্যাবস্হা করা হয়।ঘন্টাধ্বনি প্রভৃতি গ্রহন করা হয় খৃষ্টানদের নিকট থেকে।মোটকথা ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মই বাদশাহর চোখে সুন্দর মনে হত।তার চোখে সবচেয়ে সুন্দর মনে হতো হিন্দুধর্ম।তাই তার নতুন ধর্ম 'দ্বীন-ই-ইলাহির' বেশীর ভাগ উপাদানই গৃহীত হয়েছিল হিন্দুধর্ম হতে।তাই সঙ্গত কারনেই হিন্দু এবং রাজপুতদের নিকটই এই অদ্ভুত ধর্ম সমাদর লাভ করেছিল সবচাইতে বেশী।সম্ভবত বাদশাহ আকবেরর কাম্যও ছিল তাই।
দীন-ই-ইলাহির মূলমন্ত্র ছিল ''লা ইলাহা ইল্লালাহু আকবারু খলিলুল্লাহì''
দীন-ই-ইলাহির লোকেরা চিঠিপত্রের শিরোনামে 'আল্লাহ আকবর'
লিখিত এবং পরস্পরের সাক্ষাতের সময় সালামের পরিবর্তে একজন বলত
'আল্লাহ আকবর'' এবং অপরজন এর জবাবে বলত 'জাল্লাজালালুহু'।
বাদশাহ তাহাদিগকে শিজরা স্বরূপ তাহার একখানি প্রতিকৃতি প্রদান করতেন।তারা বাদশাহর এই প্রতিকৃতি পরম শ্রদ্ধাভরে নিজ নিজ পাগড়ীতে বসিয়ে রাখত।
বাদশাহ যে সব পুজাপাবন করতেন অনুসারীগনকেও সেই সব করতে হত।উপরন্তু তাদেরকে বাদশাহকেও সেজদা করতে হত।ভন্ড সূফীদের সর্দার 'তাজুল আরেফিন' বাদশাহকে সেজদা করা ওয়াজেব বলে ফতোয়া দান করেন।এই সেজদার নাম করন করা হয় 'জমিন বোছ'।তিনি বলেন বাদশাহর প্রতি সন্মান প্রদর্শন করা ফরজে আইন এবং চেহারা কেবলায়ে হাজত ও কাবায়ে মুরাদ।হিন্দুস্হানের ভ্রষ্ট সূফীদের কার্যপ্রনালী দলীলরূপে খাড়া করে তিনি এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন।সাধারন ব্যক্তিছাড়াও বিশিষ্ট আলেমগনও এই শেরেকি কার্যে অভ্যস্হ ছিলেন।
এই নুতন ধর্মে সূদ ও জুয়া ছিল হালাল।খাছ দরবারে জুয়া খেলার জন্য একটি ঘর নির্মান করা হয় এবং জুয়াড়ীদেরকে রাজকোষ থেকে সুদি কর্জ দেয়া হত।মদ্যপান করাও হালাল সাব্যস্হ করা হয়। বাদশাহ স্বয়ং দরবারের নিকট একটি শরাবখানা খুলে দেন।নওরোজ অনুষ্ঠানে অধিকাংশ আলেম,কাজী ও মুফতিগনকে শরাব পান করতে বাধ্য করা হত।
এই ধর্মে দাড়ি মুন্ডনের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হত। বাদশাহ এই ব্যাপারে রাজপুত পত্নীদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন।
নাপাকির জন্য গোসল করা ইসলামে ফরজ।কিন্তু বাদশাহ আকবরের ধর্মে এর বিপরিত মত প্রকাশ করা হয়।বলা হয় যে 'মনী' উৎকৃষ্ট মানুষ সৃষ্টির বীজ। তাই গোসল করিয়া সহবাস করাই উত্তম।যুবতী নারীদের বাধ্যতামুলকভাবে চেহারা খুলিয়া পথ চলা ছিল এই ধর্মের আইন। শহরের বাহিরে বিভিন্ন যায়গায় পতিতাদের বসতি স্হাপন করিয়া ব্যাভিচারকে আইন সঙ্গত করা হয়।পতিতালয় গুলির নাম দেয়া হয় 'শয়তানপুর'।এই সব স্হানে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্হা করা হয়। খৎনারূপ সুন্নতকে মিটাইয়া দেবার জন্য বার বৎসরের পূর্বে বালকদের খৎনা করা নিষিদ্ধ করা হয়।
গরু জবেহ করা নিষিদ্ধ ঘোষনা করে দিলেন।কানুন জারী করলেন,কসাই এর সাথে কেউ আহার করলে তার হাত কেটে দেয়া হবে এমনকি তাহার স্ত্রীও যদি তাহার সাথে আহার করে তবে তার আঙ্গুল কাটা হবে।এই নুতন ধর্মে গরু,উট,ভেড়া প্রভৃতি জন্তুর গোশত হারাম বলিয়া ঘোষিত হল।পক্ষান্তরে বাঘ ভাল্লুকের গোশত হালালের মর্যাদা লাভ করে।আরবী ভাষা পড়া ও জানা অপরাধ বলে সাব্যস্হ হলো। জ্যোতিষশাস্ত্র,অংক,চিকিৎসা,ইতিহাস,ও কথা কাহিনী প্রভৃতি পুস্তকের প্রচলন করা হল। বাদশাহ আকবর হিন্দুদের উপর হতে জিজিয়া কর উঠিয়ে নিলেন।পূর্বে যারা 'এলমে ফেকাহ ' শিক্ষা দান করতেন তাদেরকে একশত বিঘাজমি জায়গীরসরূপ দেয়া হত। বাদশাহ আকবর এই জায়গা ছিনিয়ে নিলেন।ইসলামী আইন অনুযায়ী বিচার করার জন্য নিযুক্ত করা হত।জায়গীর প্রথা বন্দ্ধ করার ফলে ইসলামী বিচার ব্যবস্হার মূলে কুঠারাঘাত করা হল।এমনি করে ইসলামী হুকুমতের শেষ চিহ্ন টুকুও বিলুপ্ত করার জন্য বাদশাহ আকবর সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন।ফলে কয়েক বৎসরের মধ্যে হুকুমতের কোন ক্ষেত্রেই আর ইসলামের চিহ্ন অবশিষ্ট রইল না।মসজিদ বিরান হল।মাদ্রাসা ধ্বংস হল।মোট কথা সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বিরোধিতা করাই ছিল দিন-ই-ইলাহির মূল উদ্দেশ্য। অধিকাংশ আলেম দেশ ত্যাগে বাধ্য হল।
শেষ পর্যন্ত বাদশাহ আকবরের রাজত্বে এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্হিতির সৃষ্টি হল যাতে সুন্নি মুসলমানগন অতিষ্ট হয়ে উঠলেন।কারন একমাত্র সুন্নী মুসলমানগন ব্যতিত অন্য সব সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল বাদশাহর প্রিয়।কাফেররা সন্মানিত হল,মোসলমানগন হলেন অপদস্হ।ইসলামী আহকাম পালন করতে গিয়ে তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে কাফেরদের বিদ্রুপবানে জর্জরিত হতে লাগলেন।
তাঁর মোজাদ্দেদিয়াত - ১
সমগ্র হিন্দুস্হানে ইসলামের এই ঘোর দুর্দিনে হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি শায়েখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দি(রঃ) তাহার মোজাদ্দেদ সুলভ প্রজ্ঞা ও দৃঢ়সংকল্প নিয়ে সংস্কারের কর্যে ঝাপিয়ে পড়লেন।বেদাত ও কুফরীর যাতাকলে পিষ্ঠ ইসলামের ভয়াবহ দূরবস্হা দেখে তাহার ফারুকী রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল। গভীরভাবে পরিস্হতি বিশ্লেষন করে মোজাদ্দেদে আলফেছানি (রঃ) সিদ্ধান্তে আসলেন যে,সর্বপ্রথম বাদশাহর এছলাহ হওয়া প্রয়োজন।কারন বাদশাহ রূহ এবং জনগন শরীর তুল্য। রূহের ব্যাধী দুরিভূত হলে শরীরও ব্যাধিমুক্ত হবে।কিন্তু বাদশাহর এছলাহ হওয়ার পুর্বে আমিরওমরাহ গনের এছলাহ হওয়া প্রয়োজন। হজরত মোজাদ্দেদ (রঃ) সেই দিকেই মনোনিবেশ করলেন। মোজাদ্দেদ (রহ.) রোগের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে দেখতে পান তৎকালীন ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মুসলমান মূল ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে মনগড়া ইসলাম অনুসরণ করেছে। জাতির আলেমগণ তখন দুনিয়াদারীর লোভে পথভ্রষ্ট ও বিপদগামী।
১. মূল ইসলামের দিকে ফিরে আসতে হবে-
তিনি লিখেন, একটি বৃক্ষ যত বড়ই হোক মূলের সাথে তাকে সংযোগ বজায় রাখতেই হবে। তাহলেই সে মূল থেকে রস/জীবনীশক্তি টেনে নিতে সক্ষম হবে এবং ঊর্ধ্বাকাশ ও প্রকৃতি থেকে সূর্যালোক ও নাইট্রোজেন গ্রহণ করে সতেজ থাকতে পারবে। সুস্থ সতেজ অবস্থায় গাছ কখনো ঊর্ধ্বাকাশ ও প্রকৃতি থেকে ক্ষতিকর কোনো জিনিস গ্রহণ করে না। এভাবেই একটি গাছ বেঁচে থাকে এবং ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়। কিন্তু মূলের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন বৃক্ষ ঊর্ধ্বকাশ থেকে যত খাদ্যই গ্রহণ করুক না কেন তার মৃত্যু অনিবার্য। ইসলাম ও মুসলমানদের মূল হলো কুরআন ও রাসূল (স.)-এর সুন্নাহ। ইসলাম রূপ বৃক্ষটির সাথে যদি এর মূলের নিবীড় সংযোগ থাকে তবে সে এই মূল থেকেই রস/জীবনী শক্তি আহরণ করবে এবং প্রয়োজনবোধে পৃথিবীর অন্যান্য মতবাদ থেকে প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণ করবে, অপ্রয়োজনীয় অংশ পরিত্যাগ করবে। এভাবেই সে নিজেকে জীবন্ত, সতেজ ও পরিপূর্ণ রাখবে। মুসলমানদের অনুকরণীয় আদর্শ হলো ইসলাম। তাদের ব্যক্তিক সামষ্টিক জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ভাবধারা এবং কার্যক্রম এই আদর্শের উপরই নির্ভরশীল। যতদিন তারা এই আদর্শের উপর কায়েম থাকবে ততদিন তারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বেঁচে থাকবে। বিশ্বের নেতৃত্ব তারাই দিবে, কর্তৃত্ব তারাই করবে। কিন্তু মূল থেকে সরে গেলে তারা আর জীবন্ত জাতি হিসেবে টিকে থাকতে সক্ষম হবে না। মূলের সাথে সংযোগহীন বৃক্ষের ন্যায় অন্য জাতির জ্বালানি কাঠে পরিণত হবে। বিশ্বে তারা একটি নিকৃষ্ট, নিপীড়িত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত জাতিতে পরিণত হবে। জ্বালানি কাঠের ন্যায় অন্যের কাজে, অন্যের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহৃত হবে। নিজ জাতির কোনো কাজে আসবে না। এমনকি কুঠারের হাতল হয়ে স্বজাতির ধ্বংস সাধনে ব্যবহৃত হবে।
২. তিনি মূল ইসলামের জন্য ক্ষতিকর মতবাদসমূহকে চিহ্নিত করেন।
(ক) বিদা'ত : ইসলামে যদি কেউ নতুন কোনো কিছুর উদ্ভাবন বা সংযোজন করে যা তাতে (ইসলামে নেই তবে তা বিদআত)।
এ প্রসঙ্গে তিনি রাসূল (র.)-এর বিদায় হজ্বের ভাষণের সময় নাজিল হওয়া পবিত্র কুরআনের সর্বশেষ নাজিলকৃত আয়াত- আজ আমি দ্বীনকে তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামতকে তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করে দিলাম। আর দ্বীন (জীবন বিধান) হিসেবে ইসলামকেই তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম।) উল্লেখ করে বলেন, যে বস্তু পরিপূর্ণ হয়ে আছে তাতে বাইরের কোনো বস্তুর জন্য সামান্য কোনো স্থান থাকতে পারে না। যদি স্থান থাকে তবে সে পূর্ণ নয়- অপূর্ণ। আর পূর্ণ পানির গ্লাসে বাইরের কিছু প্রবেশ করালে সেখান থেকে মূল পানি বাইরে বেরিয়ে যাবে এবং অবশিষ্ট পানি ভেজালে পরিপূর্ণ হবে। তিনি আরো বলেন, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (স.)-এর হাদীসে বর্ণিত আদেশ-নিষেধ কিংবা আমল ও আকীদা ছাড়া অন্য কোনো উদ্ভাবিত বিষয়ের স্থান ইসলামে নেই। কুরআন সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যহীন কোনো কিছু ইসলামে অনুপ্রবিষ্ট হলে কিংবা করানো হলে তা হবে সম্পূর্ণ বেদআত- স্থান বিশেষে শিরক ও কুফর।
(খ) বেদআতে হাসানা ও সাইয়্যাহ্
মুজাদ্দেদ (র.) বেদআতে হাসানা ও সাইয়্যাহ্ নামক বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, সকল বেদআতই অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ৩টি হাদীসের উল্লেখ করেছেন।
১. ইসলামে যদি কেউ নতুন কোনো কিছুর উদ্ভাবন করে, যা তাতে (ইসলামে) নেই তবে তা পরিত্যাজ্য।
২. রাসূল (সা.) বলেছেন- তোমাদের ওপর অবশ্য কর্তব্য- আমার ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ অনুযায়ী চলা। তা থেকেই দলিল প্রমাণ নিবে এবং তাকেই দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরবে। নব-উদ্ভাবিত আমল বেদআত, প্রত্যেক বেদআতই গোমরাহী ও ভ্রান্তি।
৩. হযরত হাস্সান (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, জাতি যদি নিজের দ্বীনে কোনো বেদআত সৃষ্টি করে তাহলে আল্লাহ তাদের থেকে ঠিক অনুরূপ একটি সুন্নাতকে ছিনিয়ে নেন। এরপর সেই সুন্নাত কেয়ামত পর্যন্ত আর তাদের কাছে ফেরত আসে না।
(গ) সুন্নাত ও বেদআতের প্রকারভেদ
মুজাদ্দেদ (রহ.) বলেছেন, রাসূল (সা.)-এর সব আমল দুই ধরনের ছিল। (১) ইবাদাতের পর্যায়ভুক্ত, (২) অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত।
(১) রাসূল (সা.) যেসব আমল ইবাদাত হিসেবে করেছিলেন তার বিপরীত আমলই বেদআত-ই-মুনকার (অবশ্যই নিষিদ্ধ)। এর প্রতিরোধ ও গতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো সাচ্চা উম্মতের কর্তব্য।
(২) রাসূল (সা.) যেসব কাজ দেশপ্রথা ও অভ্যাস হিসেবে করতেন তার বিপরীত কাজকে আমি (মোজাদ্দেদ) বেদআতে মুনকার মনে করি না। এর প্রতিরোধ ও গতিরোধে অপ্রয়োজনীয় প্রয়াসও চালাই না। কেননা, দ্বীনের সাথে এ কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। তার উদ্ভব প্রচলিত প্রথার কারণেই হয়েছিল- দ্বীন ও মিল্লাতের কারণে নয়। তিনি (মোজাদ্দেদ) আরো বলেছেন, প্রত্যেক বেদআতী ও বিভ্রান্তি ব্যক্তি স্বীয় বাতিল আকিদার যথাযোগ্যতা প্রমাণের জন্য কুরআন ও সুন্নাহরই আশ্রয় নিয়ে থাকে ও দোহাই পাড়ে। অথচ নিঃসন্দেহে তা নিস্ফল ও নিরর্থক। এ জন্য সর্বাগ্রে আকায়েদ পরিশোধন নেহায়েত জরুরি। এরপর হালাল-হারাম, ফরজ-ওয়াজিব প্রভৃতি শরীয়তের হুকুম আহকাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন, তারপর তদানুযায়ী আমল এবং এরপরেই তাজকিয়ার (আত্মার বিশুদ্ধকরণ) স্থান।
(ঘ) পীরবাদ : এ সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (র.) বলেছেন, পীরবাদ দ্বারা আল্লাহর খলিফারা মানুষের খলিফা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে যায় শরীয়ত থেকে তরীকত। শরীয়তের অধীনে না হলে যে কোনো তরীকতই সুস্পষ্ট গোমরাহী। পীরবাদীরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণের পরিবর্তে পীরের অনুসরণ করে গোমরাহ হয়।
(ঙ) সুফীবাদ : এ সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (র.)-এর বক্তব্যের সারকথা হলো, পথভ্রষ্ট সুফীবাদের মাধ্যমে মহাবিপ্লবী মুসলমানরা হয়ে যায় মহাধ্যানী, মহাযোগী বা বৈরাগী। বনের রাজা সিংহরা পরিণত হয় গৃহপালিত বিড়ালে। মূল ইসলামে উপরোক্ত ক্ষতিকর মতবাদসমূহের অনুপ্রবেশের ফলে সম্রাট আকবরের আমলে ভারতবর্ষের আলেম সমাজ ও মুসলমানদের বেশির ভাগ সদস্যই ঈমান ও আমল হারিয়ে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছিল। এ জন্যই সম্রাট আকবরের আমলে ভারতবর্ষের পীর-সুফী বেদআতীরা আকবরের ইসলামবিরোধী অপকর্মের প্রতিবাদ করেনি এবং সঠিক ইসলামপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য আকবরের সহযোগী হয়েছিল।
মোজাদ্দেদ (রহ.) সাহেবের আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণকারী ও তৃতীয় পুত্র খাজা মাসুম বলেছেন, তিন ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবে-
১. দায়িত্বে অবহেলাকারী আলেম।
২. শরীয়তবিরোধী দরবেশ।
৩. মুর্খ সুফী। তিনি আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি আধ্যাত্মিক দীক্ষা দানকারী পীরের আসনে আসীন হয়েছে অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতের অনুসারী নয় এবং শরীয়তের অলঙ্কারে সুসজ্জিত নয়- তার থেকে দূরে অবস্থান করিও... সে আত্মগোপনকারী চোর এবং শয়তানের এজেন্ট।
৩. শরীয়ত, তরীকত ও হাকিকত সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (রহ.)-এর বক্তব্য
শরীয়তের তিন অংশ- জ্ঞান (ইলম), কর্ম (আমল) ও একাগ্রতা বা নিষ্ঠা (ইখলাস)। যতক্ষণ পর্যন্ত এ তিনটির সম্মিলন না হলো ততক্ষণ শরীয়ত হলো না। যখন শরীয়ত প্রমাণিত ও বাস্তবায়িত হয়ে গেল, আল্লাহর সন্তুষ্টিও হাসিল হয়ে গেল। ইহকালীন ও পরকালীন যাবতীয় সৌভাগ্যের চাবিকাঠি একমাত্র শরীয়ত।
তরীকত ও হাকিকত (আধ্যাত্মিকতা) সুফীদের বৈশিষ্ট্য গুণ। কিন্তু এ দুটি জিনিস শরীয়তের তৃতীয় অংশ অর্থাৎ ইসলামের পূর্ণতার জন্য শরীয়তের খাদেম বিশেষ। শরীয়তের পূর্ণতা বিধানই হচ্ছে তরীকত ও হাকিকতের একমাত্র উদ্দেশ্য।
৪. কেয়াস ও ইজতিহাদ এ প্রসঙ্গে মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর বক্তব্যের মূল কথা হলো-কেয়াস (অনুমান) ও ইজতিহাদের কোনো সম্পর্ক বেদআতের সঙ্গে নেই। কেয়াস ও ইজতিহাদ অতিরিক্ত কোনো কিছুর সৃষ্টি করে না। বরং তা একমাত্র কুরআন ও হাদীসের উদ্দেশ্য ও মর্মার্থকে প্রকাশ করে থাকে।
শায়খ আহমদ সেরহিন্দীর সংস্কার কর্মসূচি : তিনি সহজ-সরল-বোধগম্য ভাষায় তাঁর উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত মৌখিক ও লিখিত আকারে জাতির সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন ‘সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাদশাহর সম্পর্ক ঠিক তেমন- যেমন সম্পর্ক দেহের সাথে মনের। মন যদি ঠিক থাকে তবে দেহও ঠিক থাকে। যদি মন বিগড়ে যায় তবে দেহ বিপথগামী হয়। সুতরাং বাদশাহর সংশোধন সাম্রাজ্যেরই সংশোধন। বাদশাহর বিপর্যয় সমগ্র সাম্রাজ্যের ধ্বংসের নামান্তর।
মকতুব নং-৪৭, (১ম খন্ড)-এর ৬৫ পৃষ্ঠা। এ জন্য তিনি শাসক পরিবর্তনের চাইতে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনকেই অগ্রাধিকার দেন। এর আলোকে তাঁর কর্মসূচি ছিল-
(ক) বেসরকারি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংশোধন।
(খ) উচ্চপদস্থ সরকারি আমলাদের সংশোধন।
(গ) বাদশাহর সংশোধন।
(ঘ) দুনিয়াদার ও দরবারি আলেমদের সংশোধন।
তিনি ভারতের নেতৃস্থানীয় সামরিক-বেসামরিক, সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এবং জনগণের মনোজগতে বিপ্লব সৃষ্টি করেন। উক্ত বিপ্লব তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষের চিন্তায় ও দৃষ্টিভঙ্গিতে, নৈতিকতা ও তামাদ্দুনে, রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায়, সমাজ ও অর্থনীতিতে। তাঁর একমাত্র পাথেয় ছিল- আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা, আল্লাহর সাহায্য এবং দৃঢ় মনোবল। এ লক্ষ্যে তাঁর কার্যক্রম ছিল নিম্নরূপ-
১. তিনি প্রথমত লোকদের সামনে দ্বীনের সঠিক রূপটি তুলে ধরেন, যারা তা গ্রহণ করে তাদেরকে সংঘবদ্ধ করেন এবং তাদের চারিত্রিক দিক অর্থাৎ ঈমান, আকীদা ও আচার-আচরণ সংশোধন করতে সচেষ্ট হন।
২. তিনি বেদআতের প্রকাশ্য বিরোধিতায় না গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত অনুসরণের নির্দেশ দিতেন। আর এটাকেই সফলতা ও সৌভাগ্যের একমাত্র পথ বলে ঘোষণা করতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল-‘‘বন্দেগীর সকল প্রকার হক আদায় করা এবং আল্লাহর প্রতি সর্বদা ও সব সময় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখাই মানব সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য। এই অবস্থা ঠিক তখনি সৃষ্টির হবে-মানুষ যখন দুনিয়া ও আখেরাতের মহান নেতার আদর্শকে প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বাবস্থায় পূর্ণরূপে অনুসরণ করবে।’’
পার্থিব শান্তি ও উন্নতি এবং পরকালীন মুক্তি একমাত্র নবী (সা.)-এর আদর্শের অনুসরণের উপরই নির্ভরশীল। একজন মুসলমান যখন পূর্ণভাবে নবী (সা.)-এর আদর্শের অনুসরণ করে তখনি সে আল্লাহর সত্যিকার বান্দায় পরিণত হয়। উন্নীত হয় আল্লাহর প্রেমীদের পর্যায়ে, লাভ করে সফলতা ও পূর্ণতা। এই সফলতা লাভকারী ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ বনী ইসরাইলের নবীগণের সমপর্যায়ে উন্নীত হয়।
খান খানান, খানে আজম,সৈয়দ ছদরে জাহান,মোর্তজা খান,মহব্বত খান প্রমুখ ওমরাহ গন পুর্ব হতেই মোজাদ্দেদ(রঃ) এর মুরিদ ছিলেন।তিনি তাদের দ্বারা বাদশাহ আকবরকে এইসব কুফরি কর্যকলাপ হতে তওবা করার জন্য আহ্বান জানালেন।তিনি ওমরাহগনকে নির্দেশ দিলেন -''তোমরা বাদশাহকে আমার পক্ষ থেকে বলে দাও যে,বাদশাহী ক্ষনস্হায়ী।এইসব আড়ম্বর চিরদিন থাকবে না।দুই দিনের চাকচিক্যের মোহে সত্যকে অস্বীকার করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।সুতরাং অবিলম্বে এইসব কুফরী কাজ হতে তওবা করে চিরনিরাপত্তার ধর্ম ইসলামের সুশীতল পুষ্পশোভিত বাগিচায় আগমন করা উচিৎ।নতুবা গজব আসবে।আল্লাহ পাকের গজব হতে বাচবার সাধ্য কারও নেই।আল্লাহ পাক সর্বশক্তিমান।বাদশাহীর পরোয়া তিনি করেন না।ফেরাউন,নমরুদ প্রমুখ প্রবল পরাক্রমশালী বাদশাহগনও আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।সেই গজব থেকে কেউই তাদেরকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি।''
মোর্শেদের কথামত ওমরাহগনও বাদশাহ আকবরকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।শেরেক,কুফরীর প্রভাবে তার মন পাষান হয়ে গিয়েছে।হেদায়েতের নূর সেখানে প্রবেশ করতে পারল না। বাদশাহ নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। একদিন বাদশাহ একটি অশুভ স্বপ্ন দেখলেন।স্বপ্ন তাকে অস্হির করে তুললো।রাজ্যের সমস্ত স্বপ্ন ব্যাখ্যাবিদ ও জ্যোতিষগনকে তিনি স্বপ্নের বিষয়বস্তু জানালেন এবং উহার অর্থ জানতে চাইলেন।তারা বাদশাহকে জানালেন,''এই স্বপ্নের অর্থ হছ্ছে এই যে বাদশাহর পতন অতি সন্নিকটে।'' বাদশাহ তা শুনে ভীত ও চিন্তিত হয়ে পরলেন।তিনি অনেকটা দমে গেলেন।নতুন করে ফরমান জারী করা হলো যে- পুর্বে দীন-ই-ইলাহী পালনের ব্যাপারে যে সব বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হত,এখন হতে তা থাকবে না।যারা সেজদা করতে ইছ্ছুক না -তাদেরকে আর সেজদা করতে বাধ্য করা হবে না।
এদিকে হযরত মোজাদ্দেদ আল ফেছানি (রঃ) এর সারগর্ভ বাণী ও তার উজ্জল ব্যাক্তিত্বের আলোকে আলোকিত হয়ে লোকজন দীন-ই-ইলাহীর অসত্যতা ও অসারতা বোঝতে পেরে দলেদলে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো এবং ইসলামের সুশীতল ছায়ায় এসে আশ্রয় নিতে লাগল।
সমগ্র হিন্দুস্হানে ইসলামের এই ঘোর দুর্দিনে হজরত মোজাদ্দেদ আলফেছানি শায়েখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দি(রঃ) তাহার মোজাদ্দেদ সুলভ প্রজ্ঞা ও দৃঢ়সংকল্প নিয়ে সংস্কারের কর্যে ঝাপিয়ে পড়লেন।বেদাত ও কুফরীর যাতাকলে পিষ্ঠ ইসলামের ভয়াবহ দূরবস্হা দেখে তাহার ফারুকী রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল। গভীরভাবে পরিস্হতি বিশ্লেষন করে মোজাদ্দেদে আলফেছানি (রঃ) সিদ্ধান্তে আসলেন যে,সর্বপ্রথম বাদশাহর এছলাহ হওয়া প্রয়োজন।কারন বাদশাহ রূহ এবং জনগন শরীর তুল্য। রূহের ব্যাধী দুরিভূত হলে শরীরও ব্যাধিমুক্ত হবে।কিন্তু বাদশাহর এছলাহ হওয়ার পুর্বে আমিরওমরাহ গনের এছলাহ হওয়া প্রয়োজন। হজরত মোজাদ্দেদ (রঃ) সেই দিকেই মনোনিবেশ করলেন। মোজাদ্দেদ (রহ.) রোগের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে দেখতে পান তৎকালীন ভারতবর্ষের বেশির ভাগ মুসলমান মূল ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়ে মনগড়া ইসলাম অনুসরণ করেছে। জাতির আলেমগণ তখন দুনিয়াদারীর লোভে পথভ্রষ্ট ও বিপদগামী।
১. মূল ইসলামের দিকে ফিরে আসতে হবে-
তিনি লিখেন, একটি বৃক্ষ যত বড়ই হোক মূলের সাথে তাকে সংযোগ বজায় রাখতেই হবে। তাহলেই সে মূল থেকে রস/জীবনীশক্তি টেনে নিতে সক্ষম হবে এবং ঊর্ধ্বাকাশ ও প্রকৃতি থেকে সূর্যালোক ও নাইট্রোজেন গ্রহণ করে সতেজ থাকতে পারবে। সুস্থ সতেজ অবস্থায় গাছ কখনো ঊর্ধ্বাকাশ ও প্রকৃতি থেকে ক্ষতিকর কোনো জিনিস গ্রহণ করে না। এভাবেই একটি গাছ বেঁচে থাকে এবং ফলে-ফুলে সুশোভিত হয়। কিন্তু মূলের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন বৃক্ষ ঊর্ধ্বকাশ থেকে যত খাদ্যই গ্রহণ করুক না কেন তার মৃত্যু অনিবার্য। ইসলাম ও মুসলমানদের মূল হলো কুরআন ও রাসূল (স.)-এর সুন্নাহ। ইসলাম রূপ বৃক্ষটির সাথে যদি এর মূলের নিবীড় সংযোগ থাকে তবে সে এই মূল থেকেই রস/জীবনী শক্তি আহরণ করবে এবং প্রয়োজনবোধে পৃথিবীর অন্যান্য মতবাদ থেকে প্রয়োজনীয় অংশগ্রহণ করবে, অপ্রয়োজনীয় অংশ পরিত্যাগ করবে। এভাবেই সে নিজেকে জীবন্ত, সতেজ ও পরিপূর্ণ রাখবে। মুসলমানদের অনুকরণীয় আদর্শ হলো ইসলাম। তাদের ব্যক্তিক সামষ্টিক জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ভাবধারা এবং কার্যক্রম এই আদর্শের উপরই নির্ভরশীল। যতদিন তারা এই আদর্শের উপর কায়েম থাকবে ততদিন তারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বেঁচে থাকবে। বিশ্বের নেতৃত্ব তারাই দিবে, কর্তৃত্ব তারাই করবে। কিন্তু মূল থেকে সরে গেলে তারা আর জীবন্ত জাতি হিসেবে টিকে থাকতে সক্ষম হবে না। মূলের সাথে সংযোগহীন বৃক্ষের ন্যায় অন্য জাতির জ্বালানি কাঠে পরিণত হবে। বিশ্বে তারা একটি নিকৃষ্ট, নিপীড়িত, নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত জাতিতে পরিণত হবে। জ্বালানি কাঠের ন্যায় অন্যের কাজে, অন্যের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহৃত হবে। নিজ জাতির কোনো কাজে আসবে না। এমনকি কুঠারের হাতল হয়ে স্বজাতির ধ্বংস সাধনে ব্যবহৃত হবে।
২. তিনি মূল ইসলামের জন্য ক্ষতিকর মতবাদসমূহকে চিহ্নিত করেন।
(ক) বিদা'ত : ইসলামে যদি কেউ নতুন কোনো কিছুর উদ্ভাবন বা সংযোজন করে যা তাতে (ইসলামে নেই তবে তা বিদআত)।
এ প্রসঙ্গে তিনি রাসূল (র.)-এর বিদায় হজ্বের ভাষণের সময় নাজিল হওয়া পবিত্র কুরআনের সর্বশেষ নাজিলকৃত আয়াত- আজ আমি দ্বীনকে তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নেয়ামতকে তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করে দিলাম। আর দ্বীন (জীবন বিধান) হিসেবে ইসলামকেই তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম।) উল্লেখ করে বলেন, যে বস্তু পরিপূর্ণ হয়ে আছে তাতে বাইরের কোনো বস্তুর জন্য সামান্য কোনো স্থান থাকতে পারে না। যদি স্থান থাকে তবে সে পূর্ণ নয়- অপূর্ণ। আর পূর্ণ পানির গ্লাসে বাইরের কিছু প্রবেশ করালে সেখান থেকে মূল পানি বাইরে বেরিয়ে যাবে এবং অবশিষ্ট পানি ভেজালে পরিপূর্ণ হবে। তিনি আরো বলেন, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (স.)-এর হাদীসে বর্ণিত আদেশ-নিষেধ কিংবা আমল ও আকীদা ছাড়া অন্য কোনো উদ্ভাবিত বিষয়ের স্থান ইসলামে নেই। কুরআন সুন্নাহর সাথে সামঞ্জস্যহীন কোনো কিছু ইসলামে অনুপ্রবিষ্ট হলে কিংবা করানো হলে তা হবে সম্পূর্ণ বেদআত- স্থান বিশেষে শিরক ও কুফর।
(খ) বেদআতে হাসানা ও সাইয়্যাহ্
মুজাদ্দেদ (র.) বেদআতে হাসানা ও সাইয়্যাহ্ নামক বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, সকল বেদআতই অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ৩টি হাদীসের উল্লেখ করেছেন।
১. ইসলামে যদি কেউ নতুন কোনো কিছুর উদ্ভাবন করে, যা তাতে (ইসলামে) নেই তবে তা পরিত্যাজ্য।
২. রাসূল (সা.) বলেছেন- তোমাদের ওপর অবশ্য কর্তব্য- আমার ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ অনুযায়ী চলা। তা থেকেই দলিল প্রমাণ নিবে এবং তাকেই দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরবে। নব-উদ্ভাবিত আমল বেদআত, প্রত্যেক বেদআতই গোমরাহী ও ভ্রান্তি।
৩. হযরত হাস্সান (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, জাতি যদি নিজের দ্বীনে কোনো বেদআত সৃষ্টি করে তাহলে আল্লাহ তাদের থেকে ঠিক অনুরূপ একটি সুন্নাতকে ছিনিয়ে নেন। এরপর সেই সুন্নাত কেয়ামত পর্যন্ত আর তাদের কাছে ফেরত আসে না।
(গ) সুন্নাত ও বেদআতের প্রকারভেদ
মুজাদ্দেদ (রহ.) বলেছেন, রাসূল (সা.)-এর সব আমল দুই ধরনের ছিল। (১) ইবাদাতের পর্যায়ভুক্ত, (২) অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত।
(১) রাসূল (সা.) যেসব আমল ইবাদাত হিসেবে করেছিলেন তার বিপরীত আমলই বেদআত-ই-মুনকার (অবশ্যই নিষিদ্ধ)। এর প্রতিরোধ ও গতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো সাচ্চা উম্মতের কর্তব্য।
(২) রাসূল (সা.) যেসব কাজ দেশপ্রথা ও অভ্যাস হিসেবে করতেন তার বিপরীত কাজকে আমি (মোজাদ্দেদ) বেদআতে মুনকার মনে করি না। এর প্রতিরোধ ও গতিরোধে অপ্রয়োজনীয় প্রয়াসও চালাই না। কেননা, দ্বীনের সাথে এ কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। তার উদ্ভব প্রচলিত প্রথার কারণেই হয়েছিল- দ্বীন ও মিল্লাতের কারণে নয়। তিনি (মোজাদ্দেদ) আরো বলেছেন, প্রত্যেক বেদআতী ও বিভ্রান্তি ব্যক্তি স্বীয় বাতিল আকিদার যথাযোগ্যতা প্রমাণের জন্য কুরআন ও সুন্নাহরই আশ্রয় নিয়ে থাকে ও দোহাই পাড়ে। অথচ নিঃসন্দেহে তা নিস্ফল ও নিরর্থক। এ জন্য সর্বাগ্রে আকায়েদ পরিশোধন নেহায়েত জরুরি। এরপর হালাল-হারাম, ফরজ-ওয়াজিব প্রভৃতি শরীয়তের হুকুম আহকাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন, তারপর তদানুযায়ী আমল এবং এরপরেই তাজকিয়ার (আত্মার বিশুদ্ধকরণ) স্থান।
(ঘ) পীরবাদ : এ সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (র.) বলেছেন, পীরবাদ দ্বারা আল্লাহর খলিফারা মানুষের খলিফা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে যায় শরীয়ত থেকে তরীকত। শরীয়তের অধীনে না হলে যে কোনো তরীকতই সুস্পষ্ট গোমরাহী। পীরবাদীরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণের পরিবর্তে পীরের অনুসরণ করে গোমরাহ হয়।
(ঙ) সুফীবাদ : এ সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (র.)-এর বক্তব্যের সারকথা হলো, পথভ্রষ্ট সুফীবাদের মাধ্যমে মহাবিপ্লবী মুসলমানরা হয়ে যায় মহাধ্যানী, মহাযোগী বা বৈরাগী। বনের রাজা সিংহরা পরিণত হয় গৃহপালিত বিড়ালে। মূল ইসলামে উপরোক্ত ক্ষতিকর মতবাদসমূহের অনুপ্রবেশের ফলে সম্রাট আকবরের আমলে ভারতবর্ষের আলেম সমাজ ও মুসলমানদের বেশির ভাগ সদস্যই ঈমান ও আমল হারিয়ে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছিল। এ জন্যই সম্রাট আকবরের আমলে ভারতবর্ষের পীর-সুফী বেদআতীরা আকবরের ইসলামবিরোধী অপকর্মের প্রতিবাদ করেনি এবং সঠিক ইসলামপন্থীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য আকবরের সহযোগী হয়েছিল।
মোজাদ্দেদ (রহ.) সাহেবের আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণকারী ও তৃতীয় পুত্র খাজা মাসুম বলেছেন, তিন ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবে-
১. দায়িত্বে অবহেলাকারী আলেম।
২. শরীয়তবিরোধী দরবেশ।
৩. মুর্খ সুফী। তিনি আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি আধ্যাত্মিক দীক্ষা দানকারী পীরের আসনে আসীন হয়েছে অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতের অনুসারী নয় এবং শরীয়তের অলঙ্কারে সুসজ্জিত নয়- তার থেকে দূরে অবস্থান করিও... সে আত্মগোপনকারী চোর এবং শয়তানের এজেন্ট।
৩. শরীয়ত, তরীকত ও হাকিকত সম্পর্কে মুজাদ্দেদ (রহ.)-এর বক্তব্য
শরীয়তের তিন অংশ- জ্ঞান (ইলম), কর্ম (আমল) ও একাগ্রতা বা নিষ্ঠা (ইখলাস)। যতক্ষণ পর্যন্ত এ তিনটির সম্মিলন না হলো ততক্ষণ শরীয়ত হলো না। যখন শরীয়ত প্রমাণিত ও বাস্তবায়িত হয়ে গেল, আল্লাহর সন্তুষ্টিও হাসিল হয়ে গেল। ইহকালীন ও পরকালীন যাবতীয় সৌভাগ্যের চাবিকাঠি একমাত্র শরীয়ত।
তরীকত ও হাকিকত (আধ্যাত্মিকতা) সুফীদের বৈশিষ্ট্য গুণ। কিন্তু এ দুটি জিনিস শরীয়তের তৃতীয় অংশ অর্থাৎ ইসলামের পূর্ণতার জন্য শরীয়তের খাদেম বিশেষ। শরীয়তের পূর্ণতা বিধানই হচ্ছে তরীকত ও হাকিকতের একমাত্র উদ্দেশ্য।
৪. কেয়াস ও ইজতিহাদ এ প্রসঙ্গে মুজাদ্দিদ (রহ.)-এর বক্তব্যের মূল কথা হলো-কেয়াস (অনুমান) ও ইজতিহাদের কোনো সম্পর্ক বেদআতের সঙ্গে নেই। কেয়াস ও ইজতিহাদ অতিরিক্ত কোনো কিছুর সৃষ্টি করে না। বরং তা একমাত্র কুরআন ও হাদীসের উদ্দেশ্য ও মর্মার্থকে প্রকাশ করে থাকে।
শায়খ আহমদ সেরহিন্দীর সংস্কার কর্মসূচি : তিনি সহজ-সরল-বোধগম্য ভাষায় তাঁর উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত মৌখিক ও লিখিত আকারে জাতির সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন ‘সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাদশাহর সম্পর্ক ঠিক তেমন- যেমন সম্পর্ক দেহের সাথে মনের। মন যদি ঠিক থাকে তবে দেহও ঠিক থাকে। যদি মন বিগড়ে যায় তবে দেহ বিপথগামী হয়। সুতরাং বাদশাহর সংশোধন সাম্রাজ্যেরই সংশোধন। বাদশাহর বিপর্যয় সমগ্র সাম্রাজ্যের ধ্বংসের নামান্তর।
মকতুব নং-৪৭, (১ম খন্ড)-এর ৬৫ পৃষ্ঠা। এ জন্য তিনি শাসক পরিবর্তনের চাইতে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনকেই অগ্রাধিকার দেন। এর আলোকে তাঁর কর্মসূচি ছিল-
(ক) বেসরকারি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংশোধন।
(খ) উচ্চপদস্থ সরকারি আমলাদের সংশোধন।
(গ) বাদশাহর সংশোধন।
(ঘ) দুনিয়াদার ও দরবারি আলেমদের সংশোধন।
তিনি ভারতের নেতৃস্থানীয় সামরিক-বেসামরিক, সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এবং জনগণের মনোজগতে বিপ্লব সৃষ্টি করেন। উক্ত বিপ্লব তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষের চিন্তায় ও দৃষ্টিভঙ্গিতে, নৈতিকতা ও তামাদ্দুনে, রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায়, সমাজ ও অর্থনীতিতে। তাঁর একমাত্র পাথেয় ছিল- আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা, আল্লাহর সাহায্য এবং দৃঢ় মনোবল। এ লক্ষ্যে তাঁর কার্যক্রম ছিল নিম্নরূপ-
১. তিনি প্রথমত লোকদের সামনে দ্বীনের সঠিক রূপটি তুলে ধরেন, যারা তা গ্রহণ করে তাদেরকে সংঘবদ্ধ করেন এবং তাদের চারিত্রিক দিক অর্থাৎ ঈমান, আকীদা ও আচার-আচরণ সংশোধন করতে সচেষ্ট হন।
২. তিনি বেদআতের প্রকাশ্য বিরোধিতায় না গিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত অনুসরণের নির্দেশ দিতেন। আর এটাকেই সফলতা ও সৌভাগ্যের একমাত্র পথ বলে ঘোষণা করতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল-‘‘বন্দেগীর সকল প্রকার হক আদায় করা এবং আল্লাহর প্রতি সর্বদা ও সব সময় দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখাই মানব সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য। এই অবস্থা ঠিক তখনি সৃষ্টির হবে-মানুষ যখন দুনিয়া ও আখেরাতের মহান নেতার আদর্শকে প্রকাশ্যে ও গোপনে সর্বাবস্থায় পূর্ণরূপে অনুসরণ করবে।’’
পার্থিব শান্তি ও উন্নতি এবং পরকালীন মুক্তি একমাত্র নবী (সা.)-এর আদর্শের অনুসরণের উপরই নির্ভরশীল। একজন মুসলমান যখন পূর্ণভাবে নবী (সা.)-এর আদর্শের অনুসরণ করে তখনি সে আল্লাহর সত্যিকার বান্দায় পরিণত হয়। উন্নীত হয় আল্লাহর প্রেমীদের পর্যায়ে, লাভ করে সফলতা ও পূর্ণতা। এই সফলতা লাভকারী ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ বনী ইসরাইলের নবীগণের সমপর্যায়ে উন্নীত হয়।
খান খানান, খানে আজম,সৈয়দ ছদরে জাহান,মোর্তজা খান,মহব্বত খান প্রমুখ ওমরাহ গন পুর্ব হতেই মোজাদ্দেদ(রঃ) এর মুরিদ ছিলেন।তিনি তাদের দ্বারা বাদশাহ আকবরকে এইসব কুফরি কর্যকলাপ হতে তওবা করার জন্য আহ্বান জানালেন।তিনি ওমরাহগনকে নির্দেশ দিলেন -''তোমরা বাদশাহকে আমার পক্ষ থেকে বলে দাও যে,বাদশাহী ক্ষনস্হায়ী।এইসব আড়ম্বর চিরদিন থাকবে না।দুই দিনের চাকচিক্যের মোহে সত্যকে অস্বীকার করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।সুতরাং অবিলম্বে এইসব কুফরী কাজ হতে তওবা করে চিরনিরাপত্তার ধর্ম ইসলামের সুশীতল পুষ্পশোভিত বাগিচায় আগমন করা উচিৎ।নতুবা গজব আসবে।আল্লাহ পাকের গজব হতে বাচবার সাধ্য কারও নেই।আল্লাহ পাক সর্বশক্তিমান।বাদশাহীর পরোয়া তিনি করেন না।ফেরাউন,নমরুদ প্রমুখ প্রবল পরাক্রমশালী বাদশাহগনও আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।সেই গজব থেকে কেউই তাদেরকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি।''
মোর্শেদের কথামত ওমরাহগনও বাদশাহ আকবরকে নানাভাবে বুঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।শেরেক,কুফরীর প্রভাবে তার মন পাষান হয়ে গিয়েছে।হেদায়েতের নূর সেখানে প্রবেশ করতে পারল না। বাদশাহ নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। একদিন বাদশাহ একটি অশুভ স্বপ্ন দেখলেন।স্বপ্ন তাকে অস্হির করে তুললো।রাজ্যের সমস্ত স্বপ্ন ব্যাখ্যাবিদ ও জ্যোতিষগনকে তিনি স্বপ্নের বিষয়বস্তু জানালেন এবং উহার অর্থ জানতে চাইলেন।তারা বাদশাহকে জানালেন,''এই স্বপ্নের অর্থ হছ্ছে এই যে বাদশাহর পতন অতি সন্নিকটে।'' বাদশাহ তা শুনে ভীত ও চিন্তিত হয়ে পরলেন।তিনি অনেকটা দমে গেলেন।নতুন করে ফরমান জারী করা হলো যে- পুর্বে দীন-ই-ইলাহী পালনের ব্যাপারে যে সব বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হত,এখন হতে তা থাকবে না।যারা সেজদা করতে ইছ্ছুক না -তাদেরকে আর সেজদা করতে বাধ্য করা হবে না।
এদিকে হযরত মোজাদ্দেদ আল ফেছানি (রঃ) এর সারগর্ভ বাণী ও তার উজ্জল ব্যাক্তিত্বের আলোকে আলোকিত হয়ে লোকজন দীন-ই-ইলাহীর অসত্যতা ও অসারতা বোঝতে পেরে দলেদলে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলো এবং ইসলামের সুশীতল ছায়ায় এসে আশ্রয় নিতে লাগল।
No comments