মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র.) রাজনৈতিক মতাদর্শ ও বিপ্লবী কর্মসূচী


ড. আ. ফ. ম. আবু বক্কর সিদ্দিক
ইমাম-ই- রব্বানী মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র.)’র রাজনৈতিক মতাদর্শ এইরূপ ছিল: দেশের বাদশাহ জনগণের জন্য রূহ বা আত্মাদৃশ, এমতাবস্থায় রূহের ইসলাহ্ বা সংশোধনের মাধ্যমে শরীর ও অংগ-প্রত্যঙ্গের সংশোধন হইয়া থাকে। বস্তুত হযরত মুজাদ্দিদ ই আলফে সানী (র.) তাহার মুজাদ্দিদী জীবনের বিপ্লবী সংস্কার ধারায় আকবরী ফিতনার সয়লাব প্রবাহিত। ইহার প্রতিরোধের জন্য তিনি কার্যকরী ও বাস্তব কর্মসূচি গ্রহন করেন। উক্ত তিনটি ধারা ছিল:
১. বাদশাহের আমীর উমরাহগণ: তৎকালীন রাজলনতিক অবস্থা ও ঘটনাবলীর বিশেষ গতি ইহাদের অনেককে ধর্ম হইতে বিচ্যুত করিয়া হিন্দুত্বের প্রিয়পাত্র বানাইয়া ফেলিয়াছিল।
২. ‘উলামা-ই-ছু’ বা অথাৎ আলিম: ইহাদের একমাত্র অভিলাভ ছিল পার্থিব স্বার্থ লাভ করা। এই জন্য তাহারা রাজ্যের কর্ণধার ও আমীর-উমরাহদের মনস্তুটির জন্য ব্যস্ত থাকিত এবং প্রয়োজনবোধে তাহারা শরীয়তের বৈধ জিনিসকে অবৈধ এবং হারামকে হালাল বলিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করত না।
৩. ভন্ড ও গুমরাহ্ তথাকথিত সূফীগণ: এই দলের  অভিমত ছিল, শরীয়ত আওর হায়, তরীকত আওর’ অর্থাৎ শরীয়তের সহিত তরীকতের কোন সংশ্রব নাই বরং তরীকতে পূর্ণতা লাভ করলে শরীয়তের পাবন্দী বা অনুসরণ তাহাদের জন্য আর দরকার হয় না। ইহাতে কামিল ব্যক্তি আল্লাহ্ হইতে পারে এবং আল্লাহ্র বেটাও।
ফিত্নার এই উৎসত্রয় পরস্পর সংলগ্ন। মুজাদ্দিদ -ই- আলফে সানী (র.) ইহাদের গতি ও চিন্তাধারাকে পরিশুদ্ধ করিবার জন্য পূর্ণ শক্তি ও হিকমতের মাধ্যমে স্বীয় মুজাদ্দিদী খিদমত সম্পাদন করিয়া কামিয়াব হন।  তিনি তাহার মুজাদ্দিদ সুলভ তীক্ষœ জ্ঞান দ্বারা ইহা অনধাবন করতে সক্ষম হইয়াছিলেন যে, উপরোক্ত তিনটি ধারার ফিত্নার সংস্কার সাধন হইলেই বাদশাহ, এবং দেশের জনসাধারণ স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে সংশোধিত হইয়া যাইবে। কেননা, তাহার মতে শরীরের সহিত রূহের যেমন সম্পর্ক, ঠিক তেমনি বাদশাহের সহিত দেশের জনসাধারণের সম্পর্ক বিদ্যমান। ‘উলামা-ই-ছু’ ও ভন্ড দরবেশগণ স্বীয় স্বার্থের মায়াজালে বাদশাহকে আবদ্ধ করিয়া দ্বীন-ইসলামের সমূহ ক্ষতিসাধন করে। এই সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ্ বিন মুবারকের উক্তিটি প্রাধানযোগ্য। তিনি বলেনঃ
“দ্বীন-ইসলামকে কেবলমাত্র বাদশাহ্, দুনিয়াদার ‘আলিম ও ভন্ড সূফীগণ বরবাদ করেন।”
হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র.) তাঁহার বিপ্লবী সংস্কার কর্মসূচীতে সূচনাতে রাজ্যের আমীর-উমরাহগণের সহিত বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি করেন, যাহার ফজল তাহাদের অধিকাংশই হযরত মুজাদ্দিদের নিকট মুরীদ হইয়া তাঁহারা হালকাভুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি তাঁহাদের সহিত যে পত্র বিনিময় করেন, তাহাতে মুশীদের ন্যায় বেপরোয়া ও বেনিয়াযীর শান পরিদৃষ্ট হয়। উক্ত পত্রে বাতিল আক্বদী পরিত্যাগের জন্য তাহাঁদের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।
হযরত মুজাদ্দিদ-ই- আলফে সানী (র.) সমস্ত পদস্থ ও প্রভাবশালী রাজকর্মচারীকে অতি সতর্কতার সহিত তালিম ও তরবিয়াত  বা শিক্ষাদীক্ষা প্রদান করেন এবং তাঁহাদের ভুল আক্বিদাগুলি সংশোধন করিয়া সত্যিকার ইসলামী আদর্শের অনুসারী হিসাবে গড়িয়া তোলেন। অন্যদিকে তিনি ইহাদের সার্বিক সাহায্য ও সহযোগীতায় সরকারী শাসনযন্ত্রের গতিও নিয়ন্ত্রিত করেন। কেননা, রাজদরবারে হইাদের অবাধ গমনাগমন ছিল  এবং তাহাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট পরিমাণে বেশি। কাজেই, এইরূপ মনে করা সংগত হইবে যে, আকবর ও জাহাঙ্গীরের রাজত্বের সকল সুন্নী সরকারী কর্মচারী ছিলেন হযরত মুজাদ্দিদে বিপ্লবী সংস্কার আন্দোলনের সদস্য ও কার্যকরী কর্মপরিষদ।
এই সময় অধিকাংশ মুসলিম দেশের আমির, হাকীম, আলিম ও মাশায়েখগণ হযরত 
মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র.) সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হন এবং সকল দিক হইতে দলে দলে লোক তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য আগমন করতে থাকে। তিনি সকল শ্রেনীর লোকের শ্রদ্ধার পাত্র হন এবং তাঁহার দরবার এইরূপ মর্যাদা ও গৌরব লাভ করে যে, সেখানে কেহই মুখ খুলিতে সাহস পাইত না। এই সময় হযরত মুজাদ্দিদ শায়খ রফিউদ্দীনকে খলিফা বানাইয়া বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সৈন্যদের মধ্যে ইসলাহী উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন।
বস্তুত কোন স¤্রাটের শুদ্ধি বা সা¤্রাজ্যের সংস্কার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ইসলামের নীতি অনুযায়ি ইহা ধর্মের অন্যতম প্রধান খিদমত। হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানি (র.) এই মহান  উদ্দেশ্য সাধনের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং আল্লাহর রহমতে কামিয়াবী হাসিল করেন। তাঁহার এই গৌরবময় রক্তপাতহীন বিরাট বিপ্লবী সংস্কার কর্মধারার কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না, যাদ্বারা ঘনটাবলীর সঠিক বিবরণ জানা যাইতে পারে। অবশ্য তাঁহার মাকতুবাত শরীফই তাঁহার বিপ্লবী সংস্কার আন্দোলনের রূপরেখা পরবর্তীতে আলোচিত হইবে।
হযরত মুজাদ্দিদের মাকতুব (পত্র)- গুলি পাঠ করলে জানা যাবে যে, বাদশাহ জাহাঙ্গীরের দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনেকেই সুন্নী মতবাদের অনুসারী ছিলেন এবং তাঁহারা সকলেই হযরত মুজাদ্দিদের নিকট মুরীদ হইয়া তাঁহারা হালকাভুক্ত হন। শাহী দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণের মধ্যে নি¤েœাক্ত ব্যক্তিদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যথাঃ আবদুর রহীম খান খানান, খান জাহান, খান আযম, সদরে জাহান, মীজা দারা, কালীজ খান, নওয়াব শায়খ ফরীদ, হাকীম ফতহুল্লাহ, শায়খ আবদুল ওহাব, সৈয়দ মাহমুদ, সৈয়দ আহমদ, খিজির খান লোধী, মীর্জা বদীউজ্জামান, জাব্বারী খান, সিকান্দার খান লোধী প্রমুখ। ইঁহাদের নামে লিখিত পত্রাবলীই ইহার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ইহাদের কেহ কেহ অত্যাধিক প্রতিপত্তিশালী উচ্চ-পদস্থ বেসামরিক রাজকর্মচারী ছিলেন। এই সমস্ত ব্যক্তি জাহাঙ্গীরের রাজত্বের স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন। বিশেষভাবে আবদুর রহীম খান খানান বাদশাহ আকবরের সময় হইতে এত বেশি প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী ছিলেন যে, মনে হইত তিনি যেন অর্ধ-রাজত্বের মালিক। তিনি সা¤্রাজ্যের উন্নিতিকল্পে সব সময়ই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতেন। অনুরূপভঅবে উল্লেখিত অন্যান্য কর্মচারীও বাদশাহ জাহাঙ্গীরের রাজত্বের বিশেষ স্তম্ভস্বরূপ ছিলেন এবং বাদশাহ আকবরের রাজত্বকাল হইতেই তাঁহারা বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
আকবরের মৃত্যুর পর হিজরী ১০১৪সালের ৮ই জমাদিউস-সানী জাহাঙ্গীর দিল্লীহ মসনদে আরোহণ করেন। তিনি মৃত পিতার মতের অনুসারী হইলেও কার্যত উদার মনোভাবাপন্ন মুসলমান ছিলেন। এই সময় মুজাদ্দিদের বয়স ছিল ৪৩ বৎসর। জাহাঙ্গীর সিংহাসনের আরোহণ করার সাথে সাথেই হযরত মুজাদ্দিদ তাঁহার সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। বাদশাহদের মনোভাবের কথা উল্লেখপূর্বক তাই তিনি তাঁহার অন্যতম বিশিষ্ট মুরীদ শায়খ ফরীদের নিকট এই মর্মে একখানি গুরুত্বপূর্ণ পত্র প্রেরণ করেন। নিন্মে উহার অংশবিশেষ উদ্ধৃত হইলঃ
‘আজ ইসলামী রাজত্বের উন্নতি ও মুসলামন বাদশাহের সিংহাসনে আরোহণের খোশখবর খাস ও আম (বিশেষ ও সাধারণ) লোকের কানে পৌঁছিয়াছে। বাদশাহের মদদগার ও সাহার্যকারী হওয়া এবং শরীয়ত প্রচার ও মযহাবের শক্তিশালী মনে করে এই সাহায্য ও শক্তিবৃদ্ধি মুখেই হউক অথবা বাহুবলে।
হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র.) বাদশাহ জাহাঙ্গীরের রাজত্বের এই সময়কে তাহার সংস্কার আন্দোলনের মূলব্যান সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করেন। তিনিও তাঁহার অনুগত বিশিষ্ট আমীর-উমরাহদের দ¦ারা ইসলাহী কার্যক্রমের নমুনা স্বরূপ কতিপয় মাকতুবের সারাংশ নি¤েœ উদ্বৃত করা যাইতেছে, যাহাতে হযরত মুজাদ্দিদের ধর্মের প্রতি আবেগ ও অনুরাগ এবং তাহার কর্মপদ্ধতি ও তৎকালীন অবস্থার প্রতি বিশেষ আলোকপাত রহিয়াছে।  খান আযম ছিলেন বাদশাহ আকবরের উমরাহগণের অন্যতম। বাদশাহ জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালেও তিনি একজন বিশিষ্ট মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন। হযরত মুজাদ্দিদ তাঁহাকে লিখিতেছেনঃ
‘সত্য সংবাদদাতা হযরত রসূলুল্লাহ (দ.) ইরশাদ করিয়াছেনঃ ইসলাম ইহার প্রারম্ভকালে যেমন অপরিচিত ছিল, অচিরেই উহা পুনরায় অপরিচিত হইয়া যাইবে। কাজেই ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করিবার লক্ষ্যে যাহারা অন্যের চোখের অপরিচিত ও অপছন্দনীয় হয়-তাহাদের জন্য খোশ-খবর। বর্তমানে ইসলাম ধর্মের অসহায়তাও করুণ অবস্থা এই পর্যায়ে পৌছিয়াছে যে, কাফিরগণ প্রকাশ্যভাবে ইসলামের দোষারোপ করিতেছে। তাহারা মুসলমানদের বদনাম করিতেছে এবং নির্ভয়ে কুফরী হুকুম-আহকাম জারি করিয়া বাজার, রাস্তাঘাট ও অলিগলিতে নিজেদের প্রশংসা করিতেছে। অপরপক্ষে মুসলমানদের জন্য ইসলামের হুকুম-আহকাম প্রচার করা নিষেধ। শরীয়ত হুকুম-আহকাম পালনের জন্য তাহাদের উপর দোষরোপ ও বদনাম করা হইতেছে।
সুবহানাল্লাহী ওয়া-বিহামদিহী। এইরূপ কথিত আছে যে ‘শরীয়ত তরবারির ছায়ায় নীচে। কেননা, প্রকৃতপক্ষে শরা-শরীয়তের খুবী   (সৌন্দর্য) বাদশাহদের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু আফসোস! এখানে ব্যাপারটি বিপরীত। ইহা কতই না  হৃদয়বিদায়ক।

বর্তমানে আপনার ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অনেক বেশি। আমরা ধর্মযুদ্ধে দূর্বল এবং পরাজিত। কেবল আপনার মুখের দিকে আশান্বিত হইয়া চাহিয়া আছি। আল্লাহ্ তা’আলা যেন আপনাকে এই ধর্মযুদ্ধে সাহায্য করেন।
হযরত রাসুলল্লাহ্ (দ.) ইরশাদ করিয়াছেঃ লোকে যখন পাগল বলে, তখনই পূর্ণ ঈমান অর্জিত হয়। আসলে এই পবিত্র পাগলামীর উদ্দেশ্য হইতেছে, দীনের সাহায্য ও ইসলামের প্রতি আন্তরিক দরদ। ইহা আপনার ফিতরাত বা স্বভাবের মধ্যে পরিদৃষ্ট হইতেছে। আল-হামদুলিল্লাহ!
বর্তমান সময়টি এইরূপ যে, যখন অল্প কাজের বিনিময়ে অধিক ফল লাভ করা যায়। ‘আসহাবে কাহাফ’ বা গুহাবাসীগণ তাঁহাদের যামানায় কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হিজরত করিয়াছিলেন।  এই জন্য তাঁহাদের এই কাজটি আল্লাহর নিকট খুবই পছন্দ হয়। শত্রæর আক্রমণকালে সিপাহী অল্পস্বল্প কষ্ট করলেও তাহারা বড়ই বিশ্বাসের পাত্র হয়। এখন আপনার সামনে জিহাদের যে সুযোগ আসিয়াছে- ইহাই ‘জিহাদ-ই-আকবর’ বা সব চাইতে বড় জিহাদ। ইহাকে গনীমত মনে করিয়া এ কাজে অধিক সচেষ্ট হউন।
অতঃপর হযরত খাজা আহরার (র.) কি প্রকারে বাদশাহ ও আমীরগণের দরবারে গমণ করিয়া তাঁহাদিগকে স্বীয় চরিত্র বলে বশীভ‚ত করিয়া সংশোধন করতেন, ইহার দৃষ্টান্ত প্রদানের পর হযরত মুজাদ্দিদ লিখিয়াছেনঃ
নকশবন্দীয়া তরীকার বুযুর্গদের সহিত মহব্বত স্থাপন করার দরুণ আল্লাহ্ পাক আপনাকে এক প্রকারের প্রভাব ও দৃঢ়তা দান করিয়াছেন। সমসাময়িক ব্যক্তি ও  বন্ধুগণের দৃষ্টিতে আপনার মধ্যে ধর্মীয় মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি পাইয়াছে। এই জন্য আপনি চেষ্টা করুণ, যাহাতে মুসলমানদের মধ্যে কুফরী হুকুম-আহকাম ও মাযহাবী উদাসীনতা সৃষ্টি না হইতে পারে এবং তাহারা যেন এই খারাপ কাজ হইতে দূরে থাকিতে পারে। বিগত রাজত্বে (আকবরের শাসনামলে) এইরূপ মনে করা হইত, যেন রাসুলল্লাহ (দ.)-র ধর্মের সহিত তাহাদের শত্রæতা ও বিদ্বেষ আছে। বর্তমানে এই (জাহাঙ্গীর) রাজত্বে প্রকাশ্যভাবে এইরূপ শত্রæতা দেখা যায় না। যদিও শত্রæতা থাকে, তবে উহা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত না হওয়ার ফলস্বরূপ। যাহা হউক, এই ভয়ও অবশ্য আছে যে, উহা হইতে ক্রমে ধর্মীয় ব্যাপারে শত্রæতার সৃষ্টি হইবে এবং মুসলমানদেরকে পূনরায় বিপদের সম্মুখীন হইতে হইবে।  হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র.) বাদশাহ জাহাঙ্গীরের দরবারের একজন অন্যতম সদস্যকে ইসলাম ও মুসলমানদের দুর্দশা সম্পর্কে ইংগিত করিয়া আফসোস প্রকাশ পূর্বক লিখিতেছেনঃ
‘প্রায় এক শতাব্দী অতিবাহিত হইতে চলিল, ইসলাম ও মুসলামনদের দুর্দশা ও অসহায়তা এই পর্যায়ে পৌছিয়াছেন যে, কাফিরগণ ইসলামী মুল্কে প্রকাশ্যভাবে কুফরী হুকুম-আহকাম জারি করিয়াও সন্তুষ্ট নয় বরং তাহারা চেষ্টা করিতেছে, যাহাতে ইসলামী আহ্কাম একেবারেই নিশ্চিহ্ন হইয়া যায় এবং ইসলাম ও মুসলমানীর কোন নাম-নিশানা বাকি না থাকে। ব্যাপারটি এই পর্যন্ত গড়াইয়াছে যে, কোন মুসলমানই ইসলামের কোন শেয়ার বা রীতি-নীতি প্রকাশ করলে তাহাকে হত্যা করা হয়। হিন্দুস্থানে গরু যবেহ করা ইসলামের একটি বড় শেয়ার। কাফিরগণ জিযিয়া কর দিতে রাজী হইতে পারে কিন্তু তাহারা কখনও গরু করবানীতে রাজী হইবে না। বর্তমানে বাদশাহের (জাহাঙ্গীরের) রাজত্বের প্রারম্ভে যদি ইসলামী হুকুম-আহকাম প্রচলিত হয় এবং মুসলমানগণ ও তাহাদের ঈমানের দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, তবে উত্তম। অন্যথায় যদি এ ব্যাপারে অধিক করা হয়, তবে মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় অনুশাসনগুলি ঠিকভাবে পালন করা খুবই দুঃসাধ্য হইয়া পড়িবে। পানাহ! পানাহ! আবার পানাহ!!!
দেখা যাক, কোন্ ভাগ্যবান ব্যক্তি এই সৌভাগ্যের প্রস্তুত এবং কোন বাহাদুর উক্ত দৌলত লাভে সক্ষম।  মুফতী সদরে জাহান একজন মর্যাদাসম্পন্ন গুণী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সাইয়িদ বংশজাত ছিলেন এবং বাদশাহ আকবরের সময় দীর্ঘকাল প্রধান মুফতির দায়িত্ব পালন করেন। বাদশাহ জাহাঙ্গীরও তাঁহাকে এই দায়িত্বে নিয়োজিত রাখেন। দীনের তাজদীদের কাজে শরীক হওয়ার জন্য হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র.) তাঁহাকে উদ্বুদ্ধ করিয়া লিখিতেছেনঃ
কথিত আছে, ‘লোকেরা বাদশাহের ধর্মের অনুসরণকারী।’ এইজন্য সর্বসাধারণের সংশোধনের জন্য বাদশাহের সংশোধন খুবই জরুরী। বিগত যামানার (আকবরের সময়) কার্যকলাপ ইহার জ্বলন্ত নযীর।
বস্তুত এখন রাজত্বের মধ্যে একটি বিপ্লব আসিয়াছে এবং দীনের দুশমনের সক্রিয়তা চুর্ণ-বিচুর্ণ হইয়া গিয়াছে। কাজেই ইসলামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ তথা-আমীর-উমরা ও উলামাদের উপর দায়িত্ব ও কর্তব্য এই যে, তাঁহারা যেন দীন-ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন এবং ইসলামের ধ্বংসপ্রাপ্ত স্তম্ভগুলিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেন। কেননা, অহেতুক বিলম্বে অধিক পরিমাণ অমঙগল অনিবার্য। আমাদের ন্যায গরীবের অন্তঃকরণ বিলম্বের কারণে খুবই পেরেশান। যামানার দুঃখ-কষ্টের ছাপ এখনও মুসলানদের অন্তরে আঁকা আছে। ঘটনাবলী যেন ইহার প্রতিকারের পরিপন্থী না হয় এবং ইসলাম যেন ইহা হইতেও অসহায় অবস্থা প্রাপ্ত না হয়। বাদশাহ যে পর্যন্ত সুন্নত-ই-নববীর উন্নতির জন্য অগ্রহশীল না হন এবং বাদশাহের প্রিয়পাত্রগণও নিজেদেরকে এই কাজে নিয়োজিত করা হইতে দূরে রাখিয়া নশ্বর জীবনকে প্রিয় মনে করেন, এমতাবস্থায় বেচারা মুসলমানের উপর সময় বড়ই কঠিন ও সংকীর্ণ হইবে।
বৈরাম খানের ভাগিনা খান জাহান ছিলেন বিশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, যাহার প্রাধান্য রাজত্বের অধিকাংশ আমীল-উমরাহদের উপর ছিল। হযরত মুজাদ্দিদ (র.) দ্বীনের তাজদীদের কাজে শরীক হওয়ার জন্য তাহাকে উদ্ধুদ্ধ করিয়া একটি দীর্ঘ পত্র লেখেন। উক্ত পত্রটি মাকতুবাত শরীফের দ্বিতীয় খন্ডে ৬৭ নং মাকত‚বরূপে সংকলিত আছে। উহাতে তিনি ইসলামের সমুদয় আকাঈদ ও ইবাদত বড়ই চিত্তাকর্মক ও সুন্দররূপে বর্ণনা করিয়াছেন। পত্র পাঠে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি খান জাহানকে দীনের প্রচার ও প্রসারে সাহায্য করিবার জন্য প্রস্তুত হওয়ার তাকিদ দিতেছেন। এই পত্রের শেষাংশে তিনি লিখিতেছেনঃ
‘বর্তমান বাদশাহ (জাহাঙ্গীর) সপ্ত পুরুষ হইতে মুসলমান এবং আহল-ই-সুন্নাতুল জামাতের অন্তভর্‚ক্ত ও হানাফী মাযহাবের অনুসারী। কতক বৎসর হইল-কিয়ামতের নিকটবর্তী এবং নবুয়তের সময় হইতে দূরবর্তী - এই যামানর কিছু ‘আলিম স্বীয় অন্তরের কলুষ হইতে উৎপন্ন লোভের বদবখতীর দরুন বাদশাহ এবং আমীরগণের নৈকট হাসিল ও খোশামোদ করিয়অ মজবুত ধর্মেল মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি ও আপত্তি উত্থাপন করিয়া সরল ও নির্বোধ লোকদিগকে ধোঁকা দিতেছে। এই মহীয়ান  বাদশাহ যখন আপনার কথা ভালভাবে শ্রবণ ও গ্রহণ করতে পারেন বলিয়া প্রমাণ হয়, তখন ইহা বড় দৌলত হইবে যে, আপনি প্রকাশ্যে বা ইশারা -ইংগিত-আহ্্ল-ই-সুন্নাতুল জামাতের আকিদাগুলির সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ ‘কালিমা-ই-হক’ তথা কালিমা-ই-ইসলামকে তাহার কর্ণে পৌছাইয়া দেন এবং যতদূর সম্ভব আহল-ই-হকের কথাগুলি তাহার সম্মুখে পেশ করেন। আর সব সময় এইরূপ সুযোগ প্রাপ্তির জন্য আশান্বিত থাকুন, যাহাতে মাযহাব ও মিল্লাতের বিষয় আলোচনা আরম্ভ হইয়া যায়। কুফর যে বাতিল, ইহা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট এবং সত্য এবং কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনই কুফরী পছন্দ করেন না। নির্ভীকচিত্তে ইহার অসারতা প্রকাশের সংগে সংগে অনতিবিলম্বে ইহাদের মিথ্যা মা’বুদগুলির অসারতা প্রমাণপূর্বক মা’বুদ বরহক বা সত্য মা’বুদকে প্রতিষ্ঠা করা একান্ত দরকার।  বস্তুত কাফিরদের ধর্ম বাতিল এবং মুসলমানদের মধ্যে যে ব্যক্তি হক ও সরল পথ হইতে বিচ্যুত হইয়াছে, সে বিভ্রান্ত ও কুপথগামী। একমাত্র সরল পথ হইতেছে- হযরত রাসুলুল্লাহ (স.) ও খলীফা-ই-রাশেদীনের প্রদর্শিত পথ বা তরীকা।
তিনি আরো বলিতেছেনঃ এখন আমি প্রকৃত ব্যাপার বিধৃত করিতেছি যে, বাদশাহ হইলেন আত্মসদৃশ এবং অন্য সকল মানুষ শরীর স্বরূপ। আত্মা সুস্থ থাকিলে যেমন শরীর ভাল থাকে, তদ্রæপ আত্ম রোগাক্রান্ত হইলে শরীরও রোগগ্রস্ত হইয়া পড়ে। কাজেই, বাদশাহের ইসলাহ বা সংশোধনের উপরে রাজ্যের প্রজাদের ইসলাহ্ নির্ভরশীল। বাদশাহের ইসলাহ হইতেছে যে, সময়ের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া যেই প্রকারেই হউক- কালিমা ই ইসলামকে যেন তাহার নিকট প্রচার ও প্রকাশ করা হয়। কালিমা ই ইসলামের পর সুন্নী জামাত পন্থীদের আকিদাগুলি সময় সুযোগমত বাদশাহের কানে পৌছা দরকার এবং বাতিল মাযহাবপন্থীদের রদ বা প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। এই সম্পদ হস্তগত হইলে নবী (আ.) গণের মীরাস বা সম্পত্তি হস্তগত হয়। আপনি এই সম্মান বিনাকষ্টে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করিয়াছেন। কাজে ইহার কদর বা সম্মান করুন।
বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সময়ের বিশিষ্ট আমীর কালীজ খানের নামে লিখিত এক মাকতুবে (পত্রে) হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) তাহাকে পরহেযগারী এখতিয়ার ও দীনের প্রচার ও প্রসারে সহায়তা প্রদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করিয়া লিখিতেছেনঃ
“দ্বিতীয়ত আপনাকে এইজন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি যে, লাহোরের ন্যায় বড় শহরে আপনার ব্যক্তিত্বের দরুন শরীয়তের অনেক হুকুম-আহকাম প্রচলিত হইয়াছে। ইহাতে দীন-ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি ও শরীয়তের সাহায্য হইয়াছে। এই শহরটি হিন্দুস্থানের সকল শহরে মধ্যে কুতুবে ইরশাদের মর্যাদা রাখে। এই শহরের খায়ের ও বরকত হিন্দুস্থানের সকল শহরের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এই শহরে দীনের প্রচার ও প্রসার হইলে অন্য সকল শহরে ও স্থানে ইহার প্রচলন হইয়া যাইবে। হক সুবহানাহু তা'আলা আপনাকে সাহায্য করুন।
হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) অন্য এক মাকতুবে দ্বীনের সাহার্যকারীদের কথা বর্ণনা করিয়া লিখিতেছেন? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করিয়াছেন। 'আমার উম্মতের মধ্যে সদাসর্বদা এমন এক জামাত থাকিবে যাহার জয়ী হইয়া সত্য পথে প্রতিষ্ঠিত থাকিবে। তাহাদের বিপক্ষদল কিয়ামত পর্যন্ত তাহাদের কোনরূপ ক্ষতি করিতে পারিবে না।
হযরত মুজাদ্দিদ (র) খান জাহানকে অন্য এক পত্রে দীন-ইসলামের তাজদীদের কাজে নিজেকে নিয়োগ করিবার জন্য উদ্বুদ্ধ করিয়া লিখিতেছেন ।
......নশ্বর দুনিয়ার মিষ্টতা ও নিয়ামতগুলি ভাল মনে হয়, যদি তন্মধ্যে দ্বীনের তাবলীগ ও আমল থাকে। অন্যথায় ইহা ধ্বংসাত্মক প্রাণহরণকারী হলাহল সদৃশ যাহা চিনির সহিত মিশ্রিত এবং যারা অন্ধ ও অজ্ঞ লোককে প্রতারিত করা হইয়া থাকে।
পার্থিব মিষ্টতার প্রাণ সংহারী বিষের সংশােধন যদি হাকীমে মতলক জাল্লা শানুহুর বিষ সংহারকের দ্বারা করা হয় অর্থাৎ শরীয়তের আহকামের তিক্ততা ও মিষ্টতা দ্বারা যদি ইহার প্রতিরোধ করা হয়, তবে অতি সহজ ও সহজের উপর প্রতিষ্ঠিত এইরূপ সামান্য সংস্কারের দ্বারা চির সুখের স্থান হাসিল করা সম্ভব হয়।
যাহা হউক, ছোট বাচ্চাদের মত বাদাম ও আখরোটের লালসার শিকার না হইয়া প্রত্যেক অবস্থায় বুদ্ধি ও দূরদর্শিতা সহকারে কর্ম সম্পাদন করা উচিত। সামনে এখন যে খিদমত আছে, উহা যদি শরীয়ত-ই মুস্তফা (সা)-এর অনুসরণের সহিত সম্পাদন করা হয়, তবে এই খিদমত নবী (আ)-গণের খিদমতের অনুরূপ হইবে এবং ইহার দ্বারা ইসলাম আরো গৌরবান্বিত হইবে।
আমাদের ন্যায় ফকীরগণ যদি বৎসরের পর বৎসর ব্যাপী জীবন বিসর্জন দিয়াও চেষ্টা করে, তাহা হইলেও আপনাদের ন্যায় বাহাদুরদের সমকক্ষ হইতে পারিবে না।
দীনের কাফেলায় শরীক হইয়া তাজদীদের কাজে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করিয়া হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) তাঁহার অন্যতম মুরীদ বিশিষ্ট উমরাহ শায়খ ফরীদকে একটি নাতিদীর্ঘ পত্রে লিখিতেছেন ঃ

‘মানুষের আত্মার সহিত তাহার দেহের যেরূপ সম্পর্ক, ঠিক অনুরূপ সম্পর্ক বাদশাহ ও তাহার রাজত্বের প্রজাদের সহিত বিদ্যমান।' আত্মা ভাল থাকিলে যেরূপ দেহও ভাল থাকে, ঠিক তেমনি আত্মার মধ্যে গোলযােগ শুরু হইলে শরীরের মধ্যেও উহার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এইভাবেই রাজত্বের মংগল ও কল্যাণ বাদশাহের ভাল হওয়ার উপর নির্ভর করে এবং বাদশাহ থারাপ হইলে রাজত্বের অমংগল অপরিহার্য।
আপনি জ্ঞাত আছেন যে, বিগত যামানায় (আকবরের সময়) মুসলামনদের উপর দিয়া কি কি মসীবত চলিয়া গিয়াছে। অতীতে কাফিরগণ জয়ী হইয়া দারুল ইসলামে কুফরী হুকুম-আহকাম জারি করত । অপর পক্ষে সেখানে মুসলমানগণ ইসলামী হুকুম-আহকাম জারি করতে অপারক ছিল। এমন কি, তাহারা ইসলামী হুকুম জারি করতে সচেষ্ট হইলে তাহাদের কতল করা হইত। ।   বড়ই আক্ষেপ ও পরিতাপের বিষয় এই যে, আল্লাহ তা'আলার মাহবুব হযরত মুহাম্মদ (দ.)-এর উপর বিশ্বাস স্থাপনকারিগণ বেইয্যত ও অপদস্থ এবং তাঁহার প্রতি অবিশ্বাসীগণ সম্মানী ও বিশ্বাসভাজন। মুসলমানগণ আহত হৃদয়ে ইসলামের জন্য শোক উদ্যাপন করত এবং শত্রুগণ হাসি-তামাশা করিয়া তাহাদের যখমের উপর লবণ ছিটাইয়া দিত। হিদায়তের সূর্য গুমরাহীতে ঢাকা পড়িয়াছিল এবং সত্যের আলো মিথ্যার পর্দায় ঢাকা পড়িয়াছিল। আজ ইসলামী রাজত্বের উন্নতি এবং মুসলমান বাদশাহর (জাহাঙ্গীরের) সিংহাসন আরোহণের সুখবর সর্বশ্রেণীর লোকের কর্ণে পৌছিয়াছে । বাদশাহর মদদগার ও সাহায্যকারী হওয়া এবং শরীয়ত প্রচার ও ধর্মকে শক্তিশালী কল্পে তাহাকে পথ-প্রদর্শন করা মুসলামনগণ নিজেদের উপর কর্তব্য বলিয়া মনে করিয়াছে -এই সাহায্য ও শক্তি যোগানো মুখেই হউক অথবা বাহুবলে। সবচেয়ে বড় সাহায্য হইতেছে, কিতাব, সুন্নত ও ইযমা-ই-উম্মতের তরীকা অনুযায়ী শরীয়তের মসলা-মাসায়েলগুলি বর্ণনা করা এবং প্রয়োজনীয় আকীদাগুলি প্রকাশ করা, যাহাতে কোন বিদআত ও গুমরাহী মধ্যখানে উপনীত হইয়া পথভ্রষ্ট না করতে পারে এবং কর্ম পন্ড না করে। শরীয়তের ব্যাপারে এই প্রকারের সাহায্যই হইতেছে। আখিরাতের নাজাত কামনাকারী হকপন্থী ‘আলিমগণের বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য। দুনিয়াদার ‘আলিমগণ এই নিকৃষ্ট দুনিয়াকে সর্বতোভাবে কামনা করে। তাহাদের সংগলাভ মারাত্মক হলাহল সদৃশ এবং তাহাদের সৃষ্ট ফিতনা-ফাসাদ সংক্রামক ব্যাধির মত। কবির ভাষায়?
ভোগ বিলাসের সুখ-সায়রে যে “আলিম রয় নিতি,
পথহারা সে, কাহারে দানিবে সুপথের পরিচিতি 
বিগত যামানায় যে সমস্ত মসীবত ইসলাম ও মুসলমানদের উপর আপতিত হইয়াছিল, তাহার অন্যতম কারণ ছিল এই দলের অপকর্ম। প্রকৃতপক্ষে বাদশাহ (আকবর)- কে ইহারই গুমরাহ ও পথভ্রষ্ট করিয়াছিল। গুমরাহীর ৭২টি পথ অবলম্বনকারীদের পরিচালনাকারী ও পেশ ইমামও হইতেছে এই সমস্ত নিকৃষ্ট “আলিমগণ। 'আলিম ব্যতিরেকে এইরূপ লোক বিল, যাহারা পথভ্রষ্ট হইয়াছে এবং উহাদের গুমরাহীর প্রভাব অন্য লােক পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে। এই যুগে সূফীদের পোশাক পরিহিত অধিকাংশ মুর্থ লোক ‘আলিম সাজিয়াছে এবং তাহাদের প্রচারিত ফিতনা-ফাসাদ সংক্রামক ব্যাধির মত। কোন ব্যক্তির শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও সে যদি শরীয়তের ব্যাপারে কোন প্রকার সাহায্য না করে এবং ইহার ফজল ইসলামী বিধানগুলি বাস্তবায়নে ক্রটি ঘটে, তবে এই ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য তাহাকে শাস্তি দেওয়া হইবে। এই নিঃস্ব ফকীরও নিজেকে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠায় সাহার্যকারীদের দলভুক্ত করিয়া এই ব্যাপারে চেষ্টা করতে চায়। কেননা কথিত আছেঃ ‘যে কোন সম্প্রদায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করে -সে তাহাদেরই দলভুক্ত।' এই হাদীসের মর্মানুযায়ী এই ফকীর ঐ সমস্ত বুযুর্গের জামাতের অন্তর্ভুক্ত হইতে চায়। 
হযরত ইউসূফ (আ)-কে বিক্রয় করিবার কথা প্রচারিত হইলে একজন বৃদ্ধা রমণীও কিছু রশি লইয়া সেখানে উপস্থিত হইয়াছিল। তাহার উদ্দেশ্য ছিল, সেও হযরত ইউসূফ (আ)-এর খরিদ্দারদের মধ্যে গণ্য হইতে পারে এবং তাহার সামর্থ্য ছিল ঐটুকুই। এই ব্যাপারে আমি নিজেকে উক্ত বৃদ্ধা রমণীর মতই মনে করিতেছি। ইনশাআল্লাহ ফকীর শীঘ্রই আপনার নিকট হাজির হওয়ার খাহেশ রাখে। আপনার নিকট ইহাই কামনা করি যে, আল্লাহ তা'আলা যখন আপনাকে বাদশাহর পুরাপুরি নৈকট্য দান করিয়াছেন, এমতাবস্থায় আপনি প্রকাশ্যেও গোপনে-পূর্ণভাবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর শরীয়তের প্রচার কার্যে সচেষ্ট হইবেন এবং মুসলমানদেরকে এই দুরবস্থা হইতে অব্যহতি প্রদান করবেন।
দীনের প্রচার ও প্রসারের কাজে সম্পূর্ণরূপে আত্মনিয়োগ করিবার জন্য উদ্বুদ্ধ করিয়া হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) শায়খ ফরীদকে পুনরায় লিখিয়াছেনঃ
সৃষ্টির সেরা আম্বিয়া (আ) গণমানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীনের তথা শরীয়তের আহবান করিয়াছেন এবং তাঁহাদের সমস্ত জীবন এই কাজে নিয়োজিত রাখিয়াছেন। এই সমস্ত বুযুর্গ প্রেরণের উদ্দেশ্য হইল -শরীয়তের হুকুম-আহকাম মানুষের নিকট পৌছাইয়া দেওয়া। কাজেই শরীয়তের প্রচলন করা, বিশেষ করিয়া এই সময়ের মধ্যে, যখন ইসলামের রীতি-নীতি ধসিয়া পড়িয়াছে; তখন ইহার হুকুমগুলির কোন একটিকে জীবিত করার চেষ্টা করাই সর্বোত্তম কাজ। শরীয়তের কোন একটি বিধান প্রচলনের মুকাবিলায় কোটি কোটি টাকা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার সমান নয়। কেননা, এই কাজটি সৃষ্টির সেরা নবী (আ)গণের অনুসরণের পর্যায়ভুক্ত এবং এই কাজ করার অর্থ হইল ঐ সমস্ত বুযুর্গের সহিত শরীক হওয়ার সমতুল্য।
একই রূপে, অপর এক পত্রে হযরত মুজাদ্দিদ (র) শায়খ ফরীদকে লিখিতেছেন । ‘আল্লাহ তা'আলার দরবারে দু'আ এই যে, আহল-ই-বায়তের বুযুর্গ আওলাদগণের মাধ্যমে শরীয়তের হুকুম-আহকামগুলি প্রচার লাভ করুক। ইহাই হইতেছে প্রকৃত কাজ। ইহা ব্যতীত অন্য সবই মূল্যহীন। গুমরাহীর এই তুফানের মধ্যে দূরবস্থাগ্রস্থ মুসলমানদের নাজাতের আশা আজও নবী করীম (সা)-এর আহল-ই-বায়তের কিশতীর উপর নির্ভর করিতেছে। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করিয়াছেনঃ
‘আমার আহল-ই-বায়তের উদাহরণ হযরত নূহ (আ)-এর কিশতীর অনুরূপ। যাহারা ইহাতে আরোহণ করিয়াছে, তাহারা নাজাতপ্রাপ্ত হইয়াছে এবং যাহারা ইহা হইতে দূরে রহিয়াছে, তাহারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে।'
কাজেই এই সৌভাগ্য হাসিল করিবার জন্য স্বীয় উচ্চ হিম্মতকে পূর্ণভাবে মিল্লাতের পুনর্জীবিতকরণ ও শরীয়তের প্রচলন কার্যে নিয়োজিত করার একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ তা'আলার ফজলে বুযুর্গী ও সম্মান ও শান-শওকত সমস্ত কিছুই। আপনি লাভ করিয়াছেন। ইহার সহিত যদি এই নিয়ামতটি প্রাপ্তির সুযোগ লাভ হয়, তবে সৌভাগ্যের ময়দানে আপনিই সর্বাগ্রে সফলতা লাভ করবেন। এই অধম দ্বীনের সাহায্যও শরীয়তের প্রচলন সম্পর্কে এই শ্রেণীর কথা পেশ করিবার জন্য আপনার । নিকট হাজির হইবার ইচ্ছা পোষণ করে।
উপরােক্ত পত্রগুলির দ্বারা স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত মুজাদ্দিদ-ইআলফে সানী (র) বাদশাহের সংশােধনের আগে সরকারী কর্মচারীদের ইসলাহীর প্রয়োজনীয়তা বেশি অনুভব করেন। কেননা, তাহার ধারণানুযায়ী সেই যুগে প্রচলিত সমস্ত প্রকার ফিতনা-ফাসাদের অন্যতম কারণ ছিল সরকারী শাসনযন্ত্র পরিচালনাকারী এই সমস্ত জাদরেল, আমলাগণ। । 
বস্তুত হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) কর্তৃক সংগঠিত সংস্কার আন্দোলন-এর মধ্যে শায়খ ফরীদ ছিলেন শীর্ষস্থানীয় নেতা। তাহার মনোবল বৃদ্ধির জন্য হযরত মুজাদ্দিদ (র) তাঁহার নিকট সর্বমোট ২২ খানি পত্র লিখিয়াছেন। তন্মধ্যে দ্বীনের বিভিন্ন দিকের গুরুত্ব তুলিয়া ধরিয়া হযরত মুজাদ্দিদ (র) তাঁহাকে শরীয়তের বিধি-বিধান প্রচার ও প্রসারে অংশগ্রহণ করিবার জন্য উদ্বুদ্ধ করিয়াছেন। এক মাককুব (পত্রে) তাহাকে লিখিতেছেনঃ
‘আজকাল ইসলাম বড়ই দুর্দশাগ্রস্থ। এখন ইহার শক্তি বৃদ্ধির জন্য একটি পয়সা ব্যয় করা কোটি কোটি টাকা খরচের চাইতেও উত্তম। দেখা যাক, কোন্ বাহাদুর এই বড় সম্পদটি লাভ করেন। সাধারণত দ্বীনের প্রচার ও উহার শক্তি বৃদ্ধির জন্য যে কোন সময় যে কোন ব্যক্তি অগ্রসর হইলে উহা উত্তম। কিন্তু বর্তমান অসহায় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার ন্যায় আল-ই-বায়তের বাহাদুরদের পক্ষে দীন প্রচার ও ধর্মে সাহায্য করা খুবই শোভনীয় এবং ইহা আপনাদের মত লোকদেরই বিশেষ কাজ। কেননা এই ধর্মরূপ মহাধনটি আপনাদেরই গৃহের বস্তু। আপনাদেরই বদৌলতে অন্য সকলে এই সম্পদ হাসিল করিয়াছেন। এই মহা খিদমতের সুষ্ঠু সম্পাদনই হইতেছে-রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাকিকী বা সত্য-তরীকার উত্তরাধিকারিত্ব। ইহাই সেই সময়, যাহার সম্পর্কে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁহার সাহাবাদেরকে সম্বােধন করিয়য়াছিলেনঃ।
 'আজ এই সময় যদি তোমরা আদেশ ও নিষেধের (আমর ও নেহী) এক-দশমাংশ ও পরিত্যাগ কর, তবে তোমরা ধ্বংস হইয়া যাইবে। কিন্তু ইহার পর এমন এক সময় আসিবে, যখন এক-দশমাংশ সম্পাদন করিলেই লোকেরা নাজাত পাইবে।'
এই দীর্ঘ পত্রের শেষাংশে হযরত মুজাদ্দিদ (র) আরো লিখিতেছেনঃ 'বর্তমানে ইসলামের বাদশাহর (জাহাঙ্গীর) মনযোগ কাফিরদের দিকে নাই। তাই, এখন মুসলমানদের জন্য জরুরী হইতেছে কুফরী-রুসমাতের বা রীতি-নীতির দোষত্রুটিগুলি পূর্ণরূপে বাদশাহের গোচরীভূত করা। এই ব্যাপারে আপনি প্রয়োজনবোধে কোন “আলিমকে সংগী করিয়া লইবেন। শরীয়তের হুকুম-আহকাম জারি করিবার জন্য কোন কারামত প্রকাশ করা জরুরী নয়। যদি লোককে বুঝাইবার জন্য এবং দ্বীনের তাবলীগ ও প্রচারের জন্য কোন জামাতকে কষ্টভোগ করতে হয়, তাহাও প্রকৃতপক্ষে সৌভাগ্য বটে। নবী (আ)-গণ কি কষ্ট ভোগ করেন নাই? হযরত রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করিয়াছেন ঃ 
‘আমাকে যত কষ্ট দেওয়া হইয়াছে, অন্য কোন নবীকে তত কষ্ট দেওয়া হয় নাই।'
হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) এই ধরনের অসংখ্য পত্র মাঝে মাঝে বাদশাহের 
দরবারীগণকে লিখিয়াছেন। মাকতুবাত শরীফে এরূপ বহু মাকতূবের নযীর আছে। এই সকল পত্র কেবলমাত্র বাদশাহের নিকট কলিমা-ই-হক' পৌছাইবার জন্য এবং তাহাকে সৎপথে আনয়ন করিবার জন্য বলা হয় নাই বরং ঐ সমস্ত মাকতুবে। তিনি বড়ই চিত্তাকর্ষক ও বিশদভাবে কুফর, শিরক, কাফিরদের রুসমাতের খন্ডন ও উহার দোষ বর্ণনা এবং ইসলাম ও শেয়ারে ইসলামসহ-ইসলামের তালিম বা শিক্ষাগুলির সমর্থন ও ব্যাখ্যা এরূপভাবে করিয়াছেন, যাহা একগুন বুদ্ধিমান ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির ইসলাহ ও তাহার আকীদার সংশোধনের জন্য যথেষ্ট। এই মাকতুবগুলি পাঠ করিলে অনুমিত হয় যে, তিনি বাদশাহের ঐ সমস্ত সহচর ও প্রিয়পাত্রদেরকে সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত করিয়াছিলেন যাহারা রাজ্যের মধ্যে সমধিক প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ছিলেন এবং ইহাদের মাধ্যমে তিনি স্বীয় বক্তব্য সব সময় বাদশাহের কানে পৌছাইতে সক্ষম হন।
এই হিকমত বা কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে তিনি বিরাট কামিয়াবী হাসিল করেন, যাহার ফল অল্প দিনের মধ্যেই বাদশাহের খেয়ালী-ঝোঁকের মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন সূচিত হয় এবং দুর্দশাগ্রস্থ ইসলামের প্রতি তাহার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। অবশেষে ব্যাপারটি এই পর্যায়ে আসে যে, একদা শায়খ ফরীদ বাদশাহ জাহাঙ্গীরের। নিকট হইতে এই আদেশ লাভ করেন।
দরবারের জন্য এইরূপ চারজন দীনদার ‘আলিম মনােনীত করুন, যাহারা শরীয়তে মসলা-মাসায়েলগুলি লোকদিগকে শিক্ষা দিতে পারেন; যাহার ফজল । শরীয়তের খিলাফ কোন কাজ যেন না হতে পারে।'
এই খবর হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র)-এর নিকট পৌঁছিলে তিনি খুবই আনন্দিত হন। কিন্তু তিনি তাহার মুজাদ্দিদ সুলভ দূরদৃষ্টিতে তখনই অনুধাবন করতে সক্ষম হন যে, এই সুন্দর ব্যবস্থার মধ্যেও অতি সূক্ষ্ম আশংকা লুক্কায়িত আছে। তাহার চিন্তাধারায় বাস্তব ঘটনাবলীর পূর্ণচিত্র মওজুদ ছিল এবং এই হাকীকত ও তাহার সম্মুখে ছিল যে, বাদশাহ আকবরকে কতিপয় নাফস-পুরস্ত (নাফুসের পূজারী) দুনিয়াদার ‘আলিম ইসলাম হইতে দূরে সরাইয়া দিয়া তাহাকে ধর্মচ্যুত করে। আল্লাহ না করুন, এই ধরনের ‘আলিম পুনরায় বাদশাহ জাহাঙ্গীরের দরবারে সমবেত হইলে এই সমস্ত মেহনত বরবাদ হইয়া যাইবে। এইজন্য তিনি কাল বিলম্ব না করিয়া তৎক্ষণাৎ শায়খ ফরীদ ও সদরে জাহানের নিকট দুইখানি পত্র লেখেন । শায়খ ফরীদের পত্রে তাহার দু'আ করার পর এই সুসংবাদ প্রাপ্তির জন্য আনন্দ প্রকাশ করিয়া তাহাকে ব্যাপারটির সূ² দিক অনুধাবন করিবার জন্য ইংগিত করিয়া লিখিতেছেনঃ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'আলার। মুসলমানদের জন্য ইহা হইতে বড় খুশি আর কি হইতে পারে এবং দুঃখগ্রস্থদের জন্য (দীনের ব্যাপারে) ইহা হইতে খোশ-খবর আর কি হইতে পারে। যেহেতু এই ফকীর এই উদ্দেশ্যে আপনার দিকে চাহিয়া রহিয়াছে, সেই জন্য কতিপয় জরুরী বিষয় সম্পর্কে বলা ও লিপিবদ্ধ করা অতিশয় দরকার বলিয়া মনে করে। এইজন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনি অবগত আছেন যে, গরওয়ালা ব্যক্তি পাগল হইয়া থাকে। আমি আরয করিতেছি যে, মান-মর্যাদা ও ধন-দৌলতের প্রতি একেবারে লােভ নাই এবং শরীয়ত প্রচলন ও দীনের পুনরুজ্জীবন ব্যতিরেকে যাহাদের কোন উদ্দেশ্য না থাকে, এরূপ ‘আলিম বিরল। ইহা বাস্তব সত্য যে, “আলিমদের মধ্যে চাকুরী ও মান-সম্মানের প্রত্যাশা থাকিলে সকলেই স্ব-স্ব স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বুযুর্গী প্রদর্শন করতে সচেষ্ট হইবে। এমতাবস্থায় আসল উদ্দেশ্য বানচাল হইয়া যাইবে। বিগত বাদশাহের (আকবরের) যুগে এইরূপ দুনিয়াদার ‘আলিমদের মত-বিরোধই দুনিয়ার বুকে মসীবত আনিয়াছে এবং এখনও এই আশংকা আছে। আল্লাহ তাআলা যেন নিকৃষ্ট ‘আলিমদের ফিতনা ও খারাবী হইতে আমাদের রক্ষা করেন।
প্রকৃতপক্ষে, যদি চারজনের পরিবর্তে একজনও হাক্কানী আলিম নির্বাচিত হন, তবে বড়ই সৌভাগ্যের কথা। কেননা, তাঁহার সংসর্গ পরশমণি তুল্য। যদি কোন থালিস আল্লাহওয়ালা ‘আলিম না পাওয়া যায়, তবে বিশেষ চিন্তা ও যাচাই-বাছাইয়ের দ্বারা যাহাকে ভাল মনে হয়, তাহাকে নির্বাচন করবেন। মানুষের মুক্তি যেভাবে “আলিমগণের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করে, একইভাবে এই দুনিয়ার ভাল-মন্দ তাহাদের আচার-আচরণের উপর নির্ভরশীল। শ্রেষ্ঠ ‘আলিমগণ সৃষ্টির সেরা এবং নিকৃষ্ট 'আলিমগণ মানবকুলের কলঙ্ক । কেননা, মানবজাতির হিদায়তে ও কল্যাণ তাহাদের উপর নির্ভর করে। একজন বুযুর্গ ইবলিসকে বেকার বসিয়া থাকিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করেন ঃ ব্যাপার কি? তখন উত্তরে সে বলে । এই সময়ে এক শ্রেণীর ‘আলিম আমার কাজ সম্পন্ন করিতেছে। কাজেই মানুষকে পথভ্রষ্ট ও গুমরাহ করিবার জন্য তাহারাই যথেষ্ট।
আমার উদ্দেশ্য হইল, এই ব্যাপারে খুবই চিন্তা-ভাবনা করিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। কেননা ব্যাপারটি নাগালের বাইরে গেলে আর প্রতিকার সম্ভব হইবে না। হযরত মুজাদ্দিদ একই ব্যাপারে সদরে জাহানকে যে পত্রখানা লেখেন, উহাও উল্লেখযােগ্য। পত্রে আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা এবং তাহাকে দু'আ করিবার পর লিখিতেছেনঃ
এইরূপ শ্রবণ করিতেছি যে, ইসলামের প্রতি ঝোঁক হওয়ার কারণে বাদশাহ এখন কিছু ‘আলিম' চাহিতেছেন। আল্ হামদুলিল্লাহ। আপনি সবিশেষ অবগত আছেন যে, বিগত যুগে (আকবরের সময়) যে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হইয়াছিল, উহা ছিল দুনিয়াদার ‘আলিমদের কমবখৃতির ফল। এই ব্যাপারে আশা এই যে, আপনি ভালভাবে অনুসন্ধান করিয়া দীনন্দার আলিম' নির্বাচনের ব্যবস্থা করিবেন। অসৎ 'আলিম দীনের জন্য চোরস্বরূপ। মানুষের নিকট হইতে ইযত, সম্মান, সর্দারী ও বুযুর্গী হাসিল করা হইতেছে তাহাদের আন্তরিক আশা। তাহাদের ফিতনা হইতে আল্লাহর নিকট পানাহ চাই। অবশ্য তাহাদের মধ্যে যাহারা উত্তম, তাহারা হইতেছেন মানবশ্রেষ্ঠ। কিয়ামতের দিন আল্লাহর রাস্তায় তাহাদের লেখনীকে শহীদগণের রক্তের সহিত ওজন করা হইবে এবং তাহাদের লেখনীর পাল্লা ভারী হইয়া যাইবে। মানুষের মধ্যে নিকৃষ্ট হইতেছে নিকৃষ্ট ‘আলিম এবং শ্রেষ্ঠ হইতেছেন উত্তম ‘আলিম।
উপরোক্ত পত্রগুলির দ্বারা ইহা সহজেই অনুমিত যে, হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) তাহার মুজাদ্দিদসূলভ অসামান্য দূরদর্শিতার মাধ্যমে অতি সহজেই হুকুমাতের গতি কুফর, বদ-আকীদা ও রীতি-নীতি হইতে ফিরাইয়া ইসলামের দিকে আনয়ন করেন। তিনি সর্বপ্রথম হুকুমতের অধিকাংশ আমীর-উমরাহদের ইসলাহের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, পরে ইহাদের মাধ্যমে বাদশাহের মধ্যেও পরিবর্তন আনিতে সক্ষম হন।
হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) এইরূপ সরকারী ঘঁিাট বিজয়ের পর তাহার দৃষ্টি দুনিয়াদার 'আলিম ও গুমরাহ সূফীদের প্রতি নিবদ্ধ করেন। তাহার প্রথম আঘাতেই ইহাদের অনেক শক্তি শেষ হইয়া যায়। কেননা, হুকুমাতের গতি তাহাদের মনমানসিকতার অনুরূপ থাকায় তাহাদের ফিতনা বৃদ্ধি পাইতেছিল। এক্ষণে, হুকুমাতের ধারা বদলাইয়া যাওয়ার ফজল এই বাতিল শক্তিদ্বয়ও দুর্বল হইয়া পড়ে। এতদ্ব্যতীত তিনি তাহাদের গুমরাহীর বিরুদ্ধে আলাদাভাবে জিহাদ ঘােষণা করেন।
তৎকালে উলামা-ই-ছু বা অসৎ ‘আলিমগণ গুমরাহীর দুইটি দ্বার খুলিয়া রাখিয়াছিল । যথা :
১. যোগ্যতা ও আল্লাহভীতি না থাকা সত্তে¡ও ইজতিহাদের দাবি, কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যে অর্থের দিক দিয়া হেরফের করিয়া নতুন 'আকীদা ও ধারণার আবিষ্কার এবং উহার রেওয়াজ ও প্রচার। আবুল ফজল, ফৈজী ও তাহাদের পিতা শায়খ মুবারক সর্বপ্রথম আকবরকে এই পথে আনয়ন করেন, যাহার বর্ণনা আগেই দেওয়া হইয়াছে।
২. বিদ'আত-ই-হাসানা বা উত্তম বিদ'আতের নামে শরীয়তের মধ্যে নিত্য-নতুন জিনিসের আমদানী । দ্বীন-ইসলামের উপর যে সমস্ত আঘাত উলামা-ই-ছু বা অসৎ ‘আলিমদের পক্ষ হইতে আসিয়াছিল, ইহার অধিকাংশই এই দুইটি দ্বারের মাধ্যমে আগমন করে। এই জন্য হযরত মুজাদ্দিদ (র) এই দুইটি ধ্বংসাত্মক ধারার বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম করেন। তাহার রচিত মাকতুবাত শরীফে এই দুইটি বিষয়ের বিরুদ্ধে লিখিত ৫০টি মাকতুব মওজুদ আছে। এখানে উদাহরণস্বরূপ কতিপয় মাকতূবের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত হইল।
শায়খ ফরীদের কাছে লিখিত একটি পত্রে এ পর্যায়ে হযরত মুজাদ্দিদ (র) লিখিতেছেনঃ
‘আহল-ই-সুন্নাহ ওয়াল জামাতের মতানুযায়ী স্বীয় ‘আকীদাকে দুরস্ত করা, শরীয়তের হুকুম-আহকাম যাহাদের উপর প্রযোজ্য, তাহাদের উপর প্রথম ফরয। কাজেই যাহাদের উপর শরীয়তের হুকুম প্রযোজ্য, তাহাদের প্রথম কর্তব্য আহল-ই-সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আলিমদের মতানুযায়ী স্বীয় আকীদা দুরস্ত করা। কেননা, এই বুযুর্গদের নির্ভুল মতাবলীর অনুসরণের উপরই আখিরাতের নাজাত বা মুক্তি নির্ভর করে। তাহারা ঐ দল, যাহারা রাসুলুল্লাহ (সা) ও তাহার সাহাবীগণের তরীকার উপর প্রতিষ্ঠিত। এই বুযুর্গগণ কিতাব ও সুন্নতের নির্ভরশীল ও গ্রহণযােগ্য ইলমগুলি গ্রহণ করিয়াছেন। কেননা, প্রত্যেক বিদআতী ও গুমরাহ ব্যক্তি স্বীয় বাতিল মতবাদকে নিজের খেয়াল অনুযায়ী গ্রহণ করিয়া থাকে। কাজেই তাহাদের অনুসরণ করা অনুচিত।
হযরত মুজাদ্দিদের অন্যতম মুরীদ শায়খ আমানুল্লাহকে লেখা এক পত্রে এ ব্যাপারে তিনি বলিতেছেন : 'আল্লাহ তা'আলা আপনাকে সত্য হিদায়েত দান করুন। এবং সিরাতুল মুস্তাকীমের উপর সুদৃঢ় রাখুন। আপনার জানা উচিত যে, তরীর প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তুগুলির মধ্যে বিশুদ্ধ আকীদা অন্যতম। ইহাকে সুন্নতপন্থী আলিমগণ কিতাব ও সুন্নাহ এবং সলফ-ই-সালেহীনের কার্যাবলী দ্বারা উপলব্ধি করিয়াছেন। আহল-ই-সুন্নত ওয়াল জামাতের অধিকাংশ ‘আলিম কুরআন ও হাদীসের অর্থ যেরূপ করিয়াছেন, উহা গ্রহণ করতে হইবে এবং উহা খুবই জরুরী। যদি এইরূপ মনে করা হয়, যে সমস্ত ‘আলিম কোন ব্যাপারে তাহাদের লব্ধ জ্ঞান দ্বারা যে অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন, তাহা কাশফ্ ও ইলহামের বিপরীত। এমতাবস্থায় কাশফ ও ইলহামপ্রাপ্ত জ্ঞান নয় বরং ঐ সমস্ত ‘আলিমদের মতামতই গ্রহণীয়। প্রত্যেক বিদ'আতী ও গুমরাহ ব্যক্তি আকীদাগুলিকে নিজ ধারণা অনুযায়ী কুরআন ও হাদীস শরীফ হইতে বাহির করিয়া থাকে। বস্তুত কুরআন মজীদের শান হইতেছেঃ
ইহার দ্বারা অনেকে গুমরাহ ও অনেকে হিদায়তপ্রাপ্ত হয়। সুরা বাকারা।
আমার দাবি হকপন্থী ‘আলিমগণের হৃদয়সঙ্গমকৃত অর্থই নির্ভরযােগ্য এবং উহার বিপরীত কাহারও হৃদয়সঙ্গমকৃত অর্থ নির্ভরযােগ্য নহে। উক্ত দাবি এই জন্য যে, “আলিমগণ এই অর্থগুলিকে সাহাবা-ই-কিরাম ও সলফ্-ই-সালেহীনের ফয়ূযাতের করুণা হইতে হাসিল করিয়াছেন। এইজন্য চিরন্তন নাজাত ও সাফল্য তাহাদেরই সহিত জড়িত এবং প্রকৃতপক্ষে ইহারাই আল্লাহর দল এবং আল্লাহর দলই বিজয়ী। 
অপরপক্ষে বিদ'আতে হাসানার মতবাদ, যাহার অন্তরালে নফসের পূজারী ‘আলিমগণ স্বীয় নফসানী খাহেশগুলিকে ধর্মের অংশ হিসাবে বানাইয়া রাখিয়াছিল। হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র)-এর দৃষ্টিতে ইহা খুবই মারাত্মক ও বিপজ্জনক ছিল । সেইজন্য তিনি এই মতবাদের বিরুদ্ধে সােচ্চার হইয়াছেন এবং নির্ভীক চিত্তে সম্পূর্ণ মুজাদ্দিদ সুলভ বিচারে কোন বিদ'আত হাসানা’ হওয়ার পর্যায়ভুক্ত নয় বলিয়া অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন।
এ সম্পর্কে তিনি মুফতী খাজা আবদুর রহমানকে একটি পত্রে লিখিতেছেনঃ এই ফকীর বড়ই বিনয়ের সহিত আল্লাহু তা'আলার নিকট এই দু'আ করে যে, দীনের মধ্যে যে সমস্ত নতুন বিষয় আমদানী করা হইয়াছে, যারা হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা) ও তাঁহার খলীফাগণের (রা) সময় মওজুদ ছিল না -যদিও উহা আলোর ন্যায় উষাকালীন শুভ্রতার মত পরিদৃষ্ট হয়, তবুও এই ফকীরকে যেন তিনি উহাতে জড়িত করেন। ... তাহারা বলিয়া থাকে যে, বিদআত দুই প্রকারের ঃ বিদ'আতে হাসানা ও বিদ'আতে সাইয়িআ। এই ফকীর উক্ত বিদ'আতদ্বয়ের মধ্যে কোনটিতেই সৌন্দর্য ও নূরানয়াত অবলোকন করে না। বরং ইহাতে অন্ধকার ও কদর্যতা ব্যতীত কিছুই অনুভব করে না। কেননা, সাইয়েদুল বাশার মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্ (সা) ইরশাদ করিয়াছেন ও যাহারা আমার দীনের মধ্যে এরূপ কিছু আমদানী করে, যাহা উহাতে নাই, উহা বর্জনীয়। কাজেই, যাহা বর্জনীয় উহাতে সৌন্দর্য কি প্রকারে হইতে পারে?  হযরত রসূলুল্লাহ (সা) আরো ইরশাদ করিয়াছেন : 'তোমরা নিজেদেরকে নতুন আমদানীকৃত বিষয়গুলি হইতে রক্ষা কর; কেননা প্রত্যেক নতুন আমদানীকৃত বস্তুই বিদ'আত এবং প্রত্যেক বিদআতই গুমরাহী।
‘কাজেই, যখন প্রত্যেক নতুন আমদানীকৃত বিষয়ই বিদ'আত এবং প্রত্যেক বিদ'আত গুমরাহী, এমতাবস্থায় বিদ'আতের মধ্যে সৌন্দর্যের কি অর্থ!
এ ব্যাপারে হযরত মুজাদ্দিদ (র) তাহার অন্যতম মুরীদ মীর নূ'মানের কাছে লিখিত এক পত্রে বলিতেছেন : সুন্নতের রওশন নূরকে বিদ'আতের অন্ধকার ঢাকিয়া ফেলিয়াছে এবং নতুন আমদানীকৃত বিষয়াদি রসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দীনের সৌন্দর্যকে বিকৃত করিয়া ফেলিয়াছে। ইহা হইতে ও আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, কেহ কেহ এই নতুন আমদানীকৃত জিনিসগুলিকে ‘বিদআতে হাসানা' মানে করে এবং ইহার দ্বারা দ্বীনের পরিপূরণ করতে চাহে। তাহারা এইগুলি প্রতিপালনের জন্য লোকদিগকে উৎসাহিত করে। আল্লাহু তা'আলা তাহাদিগকে সরল পথের দিহায়ত দান করুন। কিন্তু তাহারা জানে না যে, দ্বীন-ইসলাম এই বিদ'আতগুলির পূর্বেই পরিপূর্ণতা লাভ করিয়াছে ও পূর্ণ নিয়ামতপ্রাপ্ত হইয়া আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি হাসিল করিয়াছে। 
কুরআনের ভাষায় ঃ
‘আজ আমি দ্বীনকে তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করিয়া দিলাম এবং স্বীয় নিয়ামতরাজিও তোমাদের জন্য পূর্ণ করিয়া দিলাম এবং দ্বীন ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম।’

সুতরাং এই বিদ'আতগুলির দ্বারা দ্বীনের পরিপূর্ণতা অনুসন্ধান করা প্রকৃতপক্ষে উক্ত আয়াত শরীফের মর্মকে অস্বীকার করারই শামিল।
বাদশাহ আকবরের সময় গুমরাহ সূফীগণ ছিলেন মাযহাবী ফিতনার তৃতীয় উৎস। হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) ইহাদের বিরুদ্ধে তাঁহার বিপ্লবী সংস্কার আন্দোলন পরিচালিত করেন। এই সময়রে অধিকাংশ সূফী ‘ওহদাতুল জুদ’ মতবাদের অনুসারী হওয়ায় ‘ইত্তেহাদ বা আল্লাহর সহিত একত্রিত হওয়া এবং হলুল' অর্থাৎ আল্লাহর মধ্যে প্রবেশ করা-এই মতবাদে বিশ্বাস করত। হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) ইহাদের বিরুদ্ধেও কঠোর সংগ্রাম করেন এবং নির্ভীক চিত্তে এইরূপ ‘আকীদা পোষণকারীদের মুলহিদ ও যিন্দীক হিসাবে চিহ্নিত করেন। তিনি এই সম্পর্কে শায়খ আবদুল আযীয জৌনপুরীকে এক পত্রে লিখিতেছেনঃ
মুমকিনকে' (সৃষ্ট বস্তু) ‘ওয়াজীব' (আল্লাহ) মনে করা এবং উক্ত মুক্তিনের কার্যাবলী ও গুণাবলীকে আল্লাহর কার্যাবলী ও গুণাবলী হিসাবে মনে করা খুবই বেয়াদবী বরং ইহা আল্লাহ্ তা'আলার নাম ও গুণাবলী অস্বীকারের শামিল। 
অতঃপর তিনি উক্ত পত্রে মূল বিষয়টি তথা “ওহদাতুল ওজদ’ বা ‘একমাত্র আল্লাহর অস্তিত্ব বিদ্যমান'-এই মতের সংশােধন ও তৎসাহ উহাতে শায়খ মহীউদ্দিন ইবনুল আরাবী ও অন্যান্য মতামত বিশ্লেষণ করিবার পর শেষের দিকে লিখিতেছেন ঃ ‘ইত্তেহাদ' একত্রিত হওয়া] ও 'আইনিয়াত' হবহু আল্লাহর মত হওয়াতো দূরের কথা, এই দুনিয়ার কোন জিনিসের সহিত আল্লাহর কোন সমঞ্জস্য নাই। আল্লাহ 'তা'আলা সমস্ত সৃষ্টি জগত হইতে অমুখাপেক্ষী এবং তিনি ইহা হইতে দূরে-বহু দূরে। আল্লাহ তা'আলাকে সৃষ্টি জগতের অনুরূপ ও মুত্তাহিদ মনে করা, এমন কি আল্লাহর সহিত কোন জিনিসকে সম্পর্কিত করা এই ফকীরের নিকট বড়ই বেদনাদয়ক এবং কষ্টকর। আসল ব্যাপার হইল, তাহারা আল্লাহ্ তা'আলা সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে, উহা হইতে তিনি অবশ্যই পাক-পবিত্র ও মহান। তিনি এ সম্পর্কে মীর সাইয়িদ মুহিববুল্লাহ মানিকপুরীকে এক পত্রে লিখিতেছেনঃ “খবরদার, কখনও সূফীদের এইরূপ বেহুদা কথায় মুগ্ধ হইবে না এবং যে আল্লাহ্ নায়, তাহাকে আল্লাহু মনে করবে না।
হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র): একদিকে যেমন এই বিপথগামীদের দোষত্রæটি প্রকাশ করিয়া দিয়াছেন এবং এরূপ আকীদা পোষণকারীদের মুলহিদ ও যিন্দীক আখ্যায় আখ্যায়িত করিয়াছেন, অপরদিকে ‘ওহদাতুল ওজুদ' বা ‘হামা-উস্তের মতবাদ পোষণকারী বড় বড় বুযুর্গ মাশায়েখদের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করিয়া বলিয়াছেন যে, এইরূপ শব্দ হইতে তাহাদের উদ্দেশ্য হইতেছে সৃষ্টি জগতে যাহা কিছু বিদ্যমান, উহার সবই আল্লাহ তা'আলার কুদরতের বিকাশ মাত্র। অথবা এরূপও বলা যাইতে পারে যে, আল্লাহ তা'আলার ওজুদ বা অস্বিত্বই আসল এবং বাকি সব সৃষ্টি জগতের অস্তিত্ব ‘জিল্লী' বা ছায়া মাত্র। এই মর্মে হযরত মুজাদ্দিদ (র) হাজী মুহাম্মদ মু'মিনের পুত্র মুহাম্মদ সাদিকের নিকট এক পত্রে লিখিতেছেনঃ
 মুহতারাম সূফীদের মধ্যে যাহারা “ওহদাতুল ওজুদের' মতবাদে বিশ্বাসী এবং ‘হামা-উত্ত' বা সবই তিনি' বলিয়া থাকেন, ইহা হইতে তাহাদের উদ্দেশ্য এইরূপ কখনই নয় যে, সমস্ত মখলুক সরাসরি আল্লাহ তা'আলার সহিত সম্পৃক্ত। আল্লাহ রক্ষা করুন। বরং তাহারা তানজীহ' অর্থাৎ পবিত্রতার মরতবা হইতে নিচে নামিয়া ‘তাশবীহ'-সামঞ্জস্য করার স্থানে উপনীত হইয়াছেন এবং ওয়াজীবকে মুমকীনের অর্থাৎ ¯্রষ্টাকে সৃষ্টির পর্যায়ভুক্ত করিয়াছেন। ইহার সবই কুফর, ইলহাদ ও গুমরাহীর অন্তর্ভুক্ত। বরং “হাম-উস্তের' অর্থ হইল 'সবই নিস্ত' বা কিছুই নাই; একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই মওজুদ। তিনি বড়ই মহান 'ও পবিত্র। এতদ সম্পর্কে হযরত মুজাদ্দিদ (র) মাকসুদ আলী তাবরীযীর নিকট লিখিত এক পত্রে এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন ঃ “প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে, মনসুর হাল্লাজ বলিয়াছিলেন। 'আনাল হক' বা “আমিই হক' বা আল্লাহ। হযরত বায়জীদ বস্তামী (র)-এর যবান হইতে বাহির হইয়াছিলঃ 'সুবহানী মা আ’জামা শানী” অর্থাৎ ‘আমি কত পবিত্র এবং আমার শান কত মহান'! এবং তিনি আরো বলেন : লিওয়ায়ী আরফাউ মিন লিওয়ায়ে মুহাম্মদ অর্থাৎ আমার পতাকা হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর পতাকা হইতেও উচ্চ।' অতঃপর হযরত মুজাদ্দিদ (র) এ সম্পর্কে বলেন ঃ ‘যেইভাবে বাহ্যিক শরীয়তের মধ্যে ইসলাম ও কুফর আছে, অনুরূপভাবে তরীকতের মধ্যেও ইসলাম ও কুফর বিদ্যমান। শরীয়তের মধ্যে কুফর যেমন ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য, তেমনি তরীকতের মধ্যেও কুফর খুবই খারাপ এবং ইসলাম পূর্ণ পরিপক্ষ। "কুফরে তরীকত' বলা হয় 'জম'আর' বা সমন্বয়ের মাকামকে এবং এই মাকামে হক ও বাতিলের তারতম্য উঠিয়া যায়। কেননা, এই মাকামে সালিক আল্লাহর পথে বিচরণকারী) ভালমন্দরূপে আয়নাগুলির মধ্যে একমাত্র তাহার মাহবুবের বা প্রেমাস্পদের সৌন্দর্য দেখিয়া থাকে। কাজেই সালিক ভাল-মন্দ পূর্ণতা ও অপূর্ণতাকে তাওহীদের ছায়া এবং বিকাশ ছাড়া আর কিছুই অবলোকন করে না। ফজল সে সকলের সহিত সন্ধির মাকামে থাকে এবং সকলে সত্য পথে আছে বলিয়া মনে করে, কখনও কখনও সে বিকাশকে আইন মনে করিয়া সৃষ্ট বস্তুকে আল্লাহু মনে করে এবং প্রতিপালকের প্রতিপালক মনে করে। এই প্রকারের ফুল ‘জম'আর' বা সংমিশ্রণের মাকামে ফুটিয়া থাকে। । তরীকতের কোন মাশায়খে আল্লাহর মুহব্বতে বিভোর হইয়া মাঝে মধ্যে, এইরূপ শরীয়ত বিরোধী অসংগত উক্তি করিয়াছেন। তাহারা সকলেই কুফরে তরীকতের মাকামে আছেন এবং ইহা কুফর ও বেতমীবীর মাকাম। কিন্তু যে সমস্ত বগ প্রকৃত ইসলামের নিয়ামতপ্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহারা এ ধরনের বাক্যালাপ হইতে পবিত্র। তাঁহারা জাহিরী ও বাতিনীভাবে নবী (আ)-গণের অনুসরণ করেন এবং তাহাদেরই সহচর হইয়া থাকেন। কাজেই, যে ব্যক্তি শরা-বিরোধী কথা বলে এবং সকলের সহিত দোস্তী রাখিতে চাহে ও সকলে হক পথে আছেন বলিয়া ধারণা করে এবং আল্লাহ ও সৃষ্ট বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করে না ও দুইয়ের ওজুদের বিশ্বাসী নয়, এইরূপ ব্যক্তি যদি মাকামে জমআ' পর্যন্ত পৌছিয়া থাকে এবং কুফরে-তরীকত হাসিল করে অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া সকলকে ভুলিয়া যাওয়ার মাকাম হাসিল করে তবে এইরূপ ব্যক্তি আল্লাহর নিকট মকবুল। এমতাবস্থায় তাহার বেহুঁশ অবস্থার অসংগত উক্তিগুলির বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ না করিয়া শরীয়ত সংগত অর্থ করতে হইবে। যেমন আনাল হক-এর অর্থ হইতেছে-“আমি মওজুদ নহি এবং একমাত্র হকই মওজুদ।'
 যদি কেহ এইরূপ হাল (অবস্থা) হাসিলের পূর্বে এবং কামালিয়াতের (পুর্ণতার)। প্রথম ধাপে পৌছানো ব্যতিরেকে এই ধরনের অসংগত কথা বলে এবং সকলকে সত্য পথের উপর বলিয়া বিশ্বাস করে ও হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্য না করে তবে এইরূপ ব্যক্তি যিন্দীক ও মুলহিল । শরীয়তকে বাতিল করাই ইহার উদ্দেশ্য। বিশ্বের রহমতস্বরূপ নবী (আ)-গণের দাওয়াতকে মিটাইয়া দেওয়াই তাহাদের উদ্দেশ্য। কাজেই, এই শ্রেণীর শরার খেলাফ উক্তিগুলি হকপন্থী ও বাতিলপন্থী-উভয় শ্রেণীর ব্যক্তি হইতেই প্রকাশ হইয়া থাকে। হকপন্থীদের জন্য ইহা আব-ই-হায়াত এবং বাতিলপন্থীদের জন্য ইহা ধ্বংসাত্মক বিষসদৃশ। যেমন, নীল দরিয়ার পানি বনী-ইসরাঈলের জন্য সুমধুর ছিল কিন্তু কিবতীদের জন্য উহা ছিল রক্তসদৃশ।
এই মাকামে অধিকাংশ সালিকের পদস্খলন হয়। অনেক মুসলমান “আরবাবে শুকর' বা বেহুশ অবস্থা প্রাপ্তগণের উক্তিগুলি অনুসরণ করিয়া সৎ পথ হইতে বিচ্যুত হইয়া গুমরাহ হইয়া যায় এবং স্বীয় দীনকে বরবাদ করে। ইহারা জানে না যে, এই শ্রেণীর উক্তিগুলি কবুল হওয়া কতিপয় শর্তের সহিত সম্পৃক্ত, যাহা বেশী অবস্থা প্রাপ্তগণের মধ্যে মওজুদ আছে কিন্তু ইহাদের মধ্যে তাহা নাই। এই শর্তগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম হইতেছে, আল্লাহ ছাড়া আর সব কিছুকে ভুলিয়া যাওয়া এবং ইহই কল হওয়ার মাকাম । হকপন্থীগণ শুকর ও মস্তী এবং বেতমীযী হওয়া সত্তে¡ও সামান্য পরিমাণও শরা-বিরোধী কাজ করেন না। মনসূর হাল্লাজ 'আনাল হক' উক্তি করা সত্বেও জেলখানায় শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় প্রতি রাতে পাঁচ শত রাকাত নফল সালাত আদায় করতেন এবং জালিমদের প্রদত্ত হালাল খাদ্য গ্রহণ করতেন না। পক্ষান্তরে বাতিলপন্থীদের জন্য শরীয়ত পালন যেন কোহেকাফ বা ককেসাস পর্বতের ভার সদৃশ।
 উল্লিখিত বুযুর্গ ওলীগণ কর্তৃক আল্লাহর মুহব্বতের জোশে শুকর বা বেহুশী ও “গালবায়ে-হাল বা হালের আতিশয্যবশত বর্ণিত উক্তিগুলি দ্বারা আকবরী আমলের গুমরাহ তরীকতপন্থীগণ প্রমাণ করতে চেষ্টা করত যে, শরীয়ত আওর হায়, তরীকত আওর' অর্থাৎ শরীয়ত ও তরীকত দুইটি স্বতন্ত্র জিনিস।'  তরীকতপন্থীগণের কোন কোন সময় রিয়াযুত (সাধনা) করা কালীন বিচিত্র ও আশ্চর্য ধরনের কাশফ বা বিশেষ দর্শন লাভ হইয়া থাকে। কেহ কেহ ইহাতে নিজের উদ্দেশ্য পূর্ণ হইয়াছে বলিয়া মনে করিয়া ইহাকেই আল্লাহ্-প্রাপ্তির শেষ ধাপ মনে করিত। এই শ্রেণীর ধোকাবাজ বেশরা ফকীরকে সাধারণ লোক পীরের মর্যাদায় সমাসীন করাইত। ইহাদের দ্বারা কেবল সাধারণ নয় বরং অনেক ক্ষেত্রে সত্যিকার ভাল লোকও গুমরাহ হইত। 
হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) ‘ওহদাতুল ওজুদ’ মতবাদীদের এই শ্রেণীর শব্দের অন্য সূক্ষ্ম বিশ্লেষণও করিয়াছেন। নমুনাস্বরূপ নিম্নে একটি মাকতূবের অংশবিশেষ পেশ করা হইল। 
এ সম্পর্কে শায়খ সূফীকে লিখিত এক মাকতুবে হযরত মুজাদ্দিদ (র) বলিতেছেন ও কতিপয় সূফী-ই-কিরাম হইতে মুহব্বতের আতিশয্যবশত এই ধরনের উক্তি প্রকাশ। পাইয়াছে। কেননা, মুহব্বতের প্রভাব প্রেমিকের দৃষ্টি হইতে প্রেমাস্পদ ব্যতীত আর সব কিছুকেই বিলীন করিয়া দেয় এবং প্রেমিক স্বীয় প্রেমাস্পদ ব্যতীত অন্য কাহাকেও নিরীক্ষণ করে না। ইহার অর্থ এই নয় যে, বাস্তবিক পক্ষে প্রেমাস্পদ ব্যতীত আর কেহই থাকে না-কেননা, ইহা বাস্তব জ্ঞান ও শরা-বিরোধী ব্যাপার।
মোটকথা হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) একদিকে “ওহদাতুল ওজুদ' বা “হামা-উত্ত' মতবাদ পোষণকারী বুযুর্গগণের উক্তিগুলির উদ্দেশ্য বর্ণনা করিয়াছেন এবং অন্যদিকে উহার ঐ সমস্ত খারাবী ও যিন্দীসুলত মতবাদকে পরিষ্কারভাবে ইলহাদ ও কুফর বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। 
এই শ্রেণীর তথাকথিত গুমরাহ সূফীদের একটি বাতিল 'আকীদা ইহাও ছিল যে, মারিফাত হাসিল না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তা'আলার ইবাদত জরুরী। মারিফাত হাসিল হইলে আর শরীয়তের হুকুম-আহকাম পালনের প্রয়োজন নাই। এই সম্পর্কে হযরত মুজাদ্দিদ (র) শায়খ বলীউদ্দীনকে এক পত্রে লিখিতেছেন ঃ
 ‘অনেক মূর্খ ও সূফী নামধারী মুলহিদের ধারণা এই যে, একমাত্র খাস-খাস। লোকগণ আল্লাহ তা'আলার মারিফাত হাসিল করিবার জন্য আদিষ্ট। তাহাদের বক্তব্য হইল, শরীয়ত প্রতিপালনের আসল উদ্দেশ্য মা'রিফাত হাসিল করা। মা'রিফাত হাসিল হইলে আর শরীয়ত প্রতিপালনের প্রয়োজন হয় না। তাহারা তাহাদের দাবির সমর্থনে কুরআন মজীদের এই আয়াত পেশ করিয়া থাকে ঃ
‘তুমি তোমার রবের ইবাদত কর, যতক্ষণ না তোমার একীন বা প্রত্যয় দৃঢ় হয়।’ [আয়াত, ৯৯ঃ সূরা হিজর]
প্রকৃত প্রস্তাবে ইহার দ্বারা তাহারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ইবাদতের শেষ সীমা মা'রিফাত হাসিলের উপর ন্যস্ত। আল্লাহ তা'আলা ইহাদের অপদস্থ করুন, কেননা, ইহারা অতি বড় জাহিল । আরিফগণের জন্য যে পরিমাণ ইবাদতের প্রয়োজন, প্রারম্ভকারীদের জন্য ইহার এক দশমাংশও প্রয়োজন নাই।
অনুরূপভাবে এই সমস্ত  ভÐ-সূফীর ধারণা ছিল যে, বাতিন দুরস্ত হইলেই সব উদ্দেশ্য সফল হয়। কাজেই সালাত, সিয়াম ইত্যাদি জাহিরী আমলগুলি আল্লাহ্ ওয়ালাদের জন্য আবশ্যক। হযরত মুজাদ্দিদ (র) ইহাদের সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ ‘আল্লাহ তা'আলা ব্যতীত অন্য সব কিছু হইতে দীল শূন্য হওয়া এবং শরীয়ত কর্তৃক আদিষ্ট শারীরিক নেক আমলগুলি সম্পাদন ব্যতীত আত্মিক নিরাপত্তার দাবি নিছক মিথ্যা, যেমন এই দুনিয়ার শরীর ব্যতীত রূহের অস্তিত্ব অসম্ভব ও ধারণাতীত। বর্তমান যুগে অনেক মুলহিদ এই ধরনের দাবি করিয়া থাকে। আল্লাহ্ তা'আলা তাহার হাবীব রাসূলুল্লাহ (সা)-এর তোফায়েলে এই সমস্ত বাতিল “আকীদা হইতে আমাদের হিফাযত করুন।
এই সম্পর্কে হযরত মুজাদ্দিদ (র) ফতেহ খান আফগানীকে লিখিত এক পত্রে বলিয়াছেনঃ যে ব্যক্তি জাহিরকে পরিত্যাগ করিয়া কেবল বাতিনকে দুরস্ত করতে চায়, সে মুলহিদ বা কাফির। তাহার কোন বাতিনী হাল হাসিল হইলে উহা তাহার জন্য ‘ইসতিদরাজ বা ভেলকিবাজী মাত্র। বাতিনী হালের বিশুদ্ধতা ও কবুলীয়তের চিহ্ন হইতেছে জাহিরীভাবে শরীয়তের বিধানগুলি দ্বারা সুসজ্জিত হওয়া।
অনেক জাহিল ও অন্ধ সুফী সুন্নত ও শরীয়তের তরীকা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া রিয়াযত বা কঠোর সাধনা করে এবং এই কাজকে তাহারা আল্লাহ তা'আলার সহিত মিলিত হইবার জন্য ওসীলাম্বরূপ মনে করে। বর্তমানেও এইরূপ বহু সূফী দৃষ্টিগোচর হয়। হযরত মুজাদ্দিদ (র) ইহাদের সম্পর্কে লিখিতেছেনঃ
‘সুন্নত তরীকা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া লোকগণ যে সমস্ত রিয়াযত ও মুজাহিদা করে, ইহার কোন মূল্য ও গুরুত্ব নাই । গ্রীক দেশীয় দার্শনিক ও হিন্দুস্থানের ব্রাহ্মণ ও মুনি-ঋষিগণ এইরূপ ধ্যান-ধারণা করিয়া থাকে কিন্তু ইহার দ্বারা তাহাদের একমাত্র লোকসান ও ক্ষতি ব্যতীত আর কিছুই লাভ হয় না।
ফলকথা, “ইলম-ই-তাসাউফ সম্পর্কিত এই জাতীয় ইসলাহ ছাড়াও হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র) দীন সম্পর্কীয় বহু ব্যাপারে ইসলাহ করেন। ইহা অতীব সত্য যে, হাজার বৎসরের আবর্জনা ও পাপ-পঙ্কিলতাকে তিনি দূরে নিক্ষেপ করিয়া দীন-ইসলামকে নতুনভাবে দুনিয়ার সম্মুখে প্রতিষ্ঠিত করেন। আর এই জন্যই তিনি মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী” খেতাবে ভূষিত হন।
এই গ্রস্থের উপসংহারে হযরত মুজাদ্দিদ (র) কর্তৃক খাজা শরফুদ্দীন হুসায়নীকে । লিখিত একটি মাকতুবের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ পেশ করা হইল, যাহাতে তাহার তাজদীদী-যিন্দেগীর মূল সুর ঝংকৃত হইয়াছে। তিনি লিখিতেছেনঃ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ তা'আলার জন্য এবং তাহার মনোনীত বান্দাদের প্রতি সালাম । প্রিয় বৎস! অবসর অতি অল্প। ইহা বিশেষ জরুরী যে, যেন আল্লাহ্ তা'আলা প্রদত্ত আয়ুকে বেহুদা কাজে নষ্ট না করা হয় এবং পূর্ণ জীবন যেন তাহার সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় হয়। শরীয়তের হুকুম-আহকাম পালন পূর্বক একাগ্রতা সহকারে জামাতের সহিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা দরকার। তাহাদের সালাত যেন পরিত্যক্ত না হয় এবং প্রাতঃকালীন তওবাকে যেন পরিত্যাগ না করা হয়। খরগোসের নিদ্রায়  অভিভূত হইও না এবং নশ্বর দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে নিমজ্জিত হইও না। মত্যুকে স্মরণে রাখবে এবং আখিরাতের ভীতি-বিহবল অবস্থাকে সব সময় সম্মুখে রাখবে। মোট কথা, দুনিয়া হইতে পৃষ্ট-প্রদর্শন পূর্বক আখিরাতের দিকে বিশেষভাবে মনোনিবেশ করবে। প্রয়োজনমত দুনিয়ার সহিত সম্পর্ক রাখিয়া অবশিষ্ট সময় আখিরাতের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে। সারকথা, এই যে, আল্লাহ তা'আলা ব্যতীত অন্য বস্তুর আকর্ষণ হইতে দীলকে মুক্ত রাখবে এবং জাহিরকে শরীয়তের বিধান দ্বারা সুসজ্জিত রাখবে। ইহাই প্রকৃত কাজ, বাকি সবই অর্থহীন।

ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র)-এর বিপ্লবী সংস্কার আন্দোলনের ইহাই সংক্ষিপ্ত রূপরেখা ও মূলকথা।

No comments

Powered by Blogger.