হযরত খাজা ইউসুফ হাম্দানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি


খাজা ইউসুফ হামদানি (৪৪০-৫৩৫ হি)

এলমে তাসাউফে তিনি শায়েখ আবু আলী ফারমেদী র. এর সাথে সম্পৃক্ত। খাজা আবদুল খালেক গজদাওয়ানী র. এর শরহে ওসায়ায় এরকম উল্লেখ রয়েছে যে, খাজা ইউসুফ হামাদানীর শায়েখ আবুল হাসান খেরকানী র. এর সাথে সরাসরি সম্পর্ক ছিলাে। তিনি শায়েখ আবদুল্লাহ জুওয়াইনী র. এর হাতে খেলাফতের পােশাক পরিধান করেন এবং শায়েখ হাসান সামনানীর সান্নিধ্যে সময় অতিবাহিত করেন। তাঁর উপনাম ছিলাে। আবু ইয়াকুব। তিনি আঠারাে বছর বয়সে বাগদাদে তশরীফ আনেন। আল্লামা আবু ইসহাক শিরাজী থেকে এলমে ফিকাহ অর্জন করেন এবং সঙ্গী সাথীদের উর্ধ্বে চলে যান। বাগদাদ, ইসফাহান, ইরাক, খােরাসান, সমরখন্দ, বােখারায় গমন করে বিভিন্ন বিষয়ে উপকৃত হন এবং জনসাধারণের উপকার করেন। এলমে হাদিসে তার গভীর আগ্রহ ছিলাে। লােকজন তাঁর উপদেশ নিয়ে উপকৃত হতেন। ফতওয়া, ইসলামী জ্ঞান ও আহকামে শরীয়তে পরিপূর্ণ জ্ঞানী ছিলেন তিনি। এলমে মারেফতে ছিলেন সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত। গােপনীয় বিপদ ও ক্ষতির বিষয় থেকে সতর্ক থাকতেন। কারামতের অধিকারী ছিলেন। উলামা ও ফুকাহাদের একটি বড় দল তাঁর খানকায় সমবেত হতেন এবং তার কামালাত ও বাণী দ্বারা উপকৃত হতেন। আজার বাইজান, ইরাক ও খেরাসানে স্বীয় মুরিদগণকে শিক্ষা দিতেন এবং তরবিয়ত করতেন। তিনি ওই মাশায়েখগণের অন্যতম, যারা সায়্যিদেনা শায়েখেনা মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী র. এর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন এবং তাঁর থেকে উপকৃত হয়েছিলেন।

টীকা :কালায়েদ জাওয়াহের ও বাহজাতুল আসরার নামক কিতাবদ্বয়ে খাজা ইউসুফ হামদানী র. থেকে উপকৃত হওয়া সম্পর্কিত বর্ণনা আছে। শায়েখ মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী র. এর বাণী এরূপ ঃ এক ব্যক্তি হামাদান নগরী থেকে এলেন। তাঁকে ইউসুফ হামাদানী বলা হতাে। কুতুবও বলা হতাে। তিনি সরাইখানায় অবস্থান করতেন। আমি তাঁর সম্পর্কে জানতে পেরে সরাইখানায় উপস্থিত হলাম। তাঁকে সেখানে দেখতে না পেয়ে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। আমাকে বলা হলাে, তিনি সুড়ংগের ভিতর থাকেন। আমি সেখানে গেলাম। তিনি আমাকে দেখলেন। কাছে বসিয়ে আমার সকল অবস্থা বর্ণনা করলেন এবং আমার সকল সমস্যা সমাধান করে দিলেন। বললেন, হে আবদুল কাদের! তুমি উপদেশ দান কোরাে। আমি বললাম, হে স্বনামধন্য মাওলানা! আমি অনারবী। কীভাবে বাগদাদের সাহিত্যিকদের সাথে কথা বলবাে। তিনি বললেন, তুমি কোরআন, হাদিস, ফেকাহ, উসুলে ফেকাহ, নাহু, সরফ, তাফসীর অধ্যয়ন করেছাে। তােমার জন্য তাদের সাথে কথা বলা সহজ হবে। তুমি মিম্বারে উপবেশন করাে এবং লােকদেরকে উপদেশ দিতে থাকো। আমি তােমার মধ্যে এক বিশেষ যােগ্যতা দেখেছি, যা অচিরেই বিকশিত হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রতি দয়া ও রহম করুন।

তিনি হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। মারভ শহরে বেশ সময় অতিবাহিত করেন। অতঃপর হেরাত শহরে আসেন। এরপর পুনরায় মারভ শহরে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা করেন। যাত্রাকালে পথিমধ্যে তাঁর ইন্তেকাল হয়। তিনি ষাট বছর বয়সে খেলাফত লাভ করেন। সবার কাছে ছিলেন গ্রহণযােগ্য। তিনি ছিলেন তাঁর যুগের গাউস। আজর পর্বতে অবস্থান করতেন। জুমার নামাজ ছাড়া কখনাে বের হতেন না। রাহাত, নুফহাতুল উন্স পৃষ্ঠা ৩৩৭। 
বাণী ঃ একদা জনৈক দরবেশ খাজা ইউসুফ হামাদানীর খেদমতে উপস্থিত হলেন। বললেন, আমি ওই সময় শায়েখ আহমদ গাজ্জালী র. এর পাশে ছিলাম। তিনি দস্তরখানায় দরবেশদের সাথে খানা খাচ্ছিলেন। এমন। সময় তাঁর নিকট অদৃশ্যের কিছু বিষয় প্রকাশ হচ্ছিলাে। শেষে তিনি। বললেন, ওই সময় রসূল স. তাশরীফ এনেছিলেন। তিনি স. আমার মুখে লােকমা তুলে দিলেন। শায়েখ এ সকল কথা শুনে বললেন, এ ধরনের কল্পনা দ্বারা তরিকতের শিশুরা জ্ঞান লাভ করে।
বাণী : সেমা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি দূত, যা সুসংবাদ প্রদানকারী ও অদৃশ্যের মুক্তাসদৃশ। সেমা দেহের ঔষধ, আত্মার খাদ্য, হৃদয়ের শক্তি, স্থায়িত্বের ভেদ ও ভেদ-রহস্যের প্রকাশকারী । আর কাশফ একটি প্রজ্জ্বলিত বিদ্যুৎ ও সূর্য। আত্মার সেমা হৃদয়ের শ্রবণের দ্বারা হুজুরী কলব হয় । হুজুরী নফস ব্যতীত এটা এমন যে, প্রতিটি জ্ঞানময়তা, চিন্তা-ফিকির, গবেষণা ও সাধনা করার মতাে। বাহজাতুল আসরার ১৪৬ পৃষ্ঠা।
যারা আল্লাহর প্রকৃত উপাসনাকারী, চরকা চালনার আওয়াজ শুনেও তারা আল্লাহর স্মরণমগ্ন হন।
টীকা : গইবাত অর্থ অন্তর সৃষ্টিকুলের অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। কেনােনা তখন তার ইন্দ্রিয়ানুভূতি তার নিজের অবস্থাতেই নিমগ্ন থাকেরেসালায়ে কুশাইরিয়া। আর সেমা— ওই ব্যক্তির জন্য বৈধ, যিনি সর্বদা আল্লাহর প্রেমে ডুবে থাকেন ও শরিয়তের নীতিমালা মেনে চলেন। বর্তমানে যে কাওয়ালী প্রথা চালু আছে, এর উপস্থাপনকারী ও শ্রবণকারী উভয়ই শরীয়তের নীতিমালা থেকে বহু দূরে। তাই বুজর্গানে দ্বীনের সেমার বৈধতায় বর্তমানের সেমাকে বৈধ বলা যায় না।
কারামাত ১ ঃ বর্ণিত আছে, পাশ্চাত্যের লােকেরা হামাদানের এক। মহিলার ছেলেকে বন্দী করে ছিলাে। মহিলা কান্নাকাটি করতে করতে শায়েখের দরবারে উপস্থিত হলাে এবং নিজের অবস্থা বর্ণনা করলাে । হজরত তাকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দিলেন। মহিলা বললাে, আমার ধৈর্যধারণ করা সম্ভব নয়। শায়েখ তখনই হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন, হে আল্লাহ্! দয়া করে বন্দীকে মুক্ত করে দাও। এরপর মহিলাকে বললেন, বাড়িতে ফিরে যাও, ছেলেকে বাড়িতেই পাবে। মহিলা বাড়িতে এসেই ছেলেকে দেখতে পেলাে। বিস্মিত ও আনন্দিত হলাে। ছেলাে বললাে, আমি কুসতানতানিয়ায় ছিলাম। আমার পায়ে বেড়ি ছিলাে। ছিলাম সশস্ত্র প্রহরীবেষ্টিত। এমন সময় অচেনা এক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে এক পলকে আমাকে এখানে নিয়ে এলেন। মহিলা পুনরায় খাজা সাহেবের নিকট গেলাে এবং ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা দিলাে। তিনি বললেন, আল্লাহর কুদরতের উপর আশ্চর্যবােধ করছাে কেনাে? বাহজাতুল আসরার ১৪৭ পৃষ্ঠা। 
কারামত ২ঃ বর্ণিত আছে, হজরত শায়েখ একদিন ওয়াজ করছিলেন। সেই মজলিশে দু’জন মুফতি উপস্থিত ছিলাে। তারা বললাে, চুপ করুন।। আপনি বেদাতী । তিনি বললেন, তােমরাই চুপ থাকো। তােমাদের ধ্বংস হােক। তৎক্ষণাৎ তারা মারা গেলাে। কালাইদে জাওয়াহের।।
 কারামত ৩ ঃ একদা তিনি বাগদাদের নেজামিয়ায় ওয়াজ করছিলেন। এমতাবস্থায় প্রসিদ্ধ ফকীহ ইবনে সিকা ওয়াজের মজলিশ থেকে উঠে তাঁকে একটি প্রশ্ন করলেন। তিনি বললেন, তুমি বসে যাও। তােমার কথায় আমি কুফরির ঘ্রাণ পাচ্ছি। তােমার মৃত্যু ইসলামের উপর হবে না। এ ঘটনার বেশ কিছু দিন পর রােমের বাদশাহর পক্ষ থেকে এক খৃষ্টান দূত খলিফার নিকটে এলাে। ইবনে সিকা সেই দূতের সঙ্গে দেখা করে তার সাথী হবার ইচ্ছা প্রকাশ করলাে। বললাে, আমি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে তােমাদের ধর্মে প্রবেশ করতে চাই। খৃষ্টান দূত তার আবেদন মঞ্জুর করলাে। তাকে সঙ্গে করে কুসতুনতানিয়ায় নিয়ে গেলাে। রােমের বাদশাহর সাথে তার পরিচয়। করিয়ে দিলাে। ইবনে সিকা খৃষ্টান হয়ে সেই ধর্মের উপরেই মারা গেলাে।

কথিত আছে, ইবনে সিকা কোরআনের হাফেজ ছিলাে। খৃষ্টান হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলাে, কোরআনুল করীমের কোনাে আয়াত তােমার মনে আছে কি? সে বললাে না। শুধু মনে আছে এ আয়াতটি—
(কখনাে কখনাে কাফেরেরা আকাঙ্ক্ষা করিবে যে, তাহারা যদি মুসলিম হইত। সূরা হিজর আয়াত ২)।
কেউ কেউ ইবনে সিকার ঘটনা অন্যভাবেও ব্যক্ত করেছেন। এই গ্রন্থের প্রণেতা এ ঘটনাটি হজরত শায়েখ আবদুল কাদের জিলানী র. এর জীবনীতেও উল্লেখ করেছেন। খাজা ইউসুফ হামাদানী র. ৪৪০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৫৩৫ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে প্রথমে তাঁর। ইন্তেকালের স্থান মারভের রাস্তায় দাফন করা হয়। পরবর্তীতে তার শরীর। মােবারক মারতে স্থানান্তরিত করা হয়। এখনাে লােকজন তাঁর কবর। জিয়ারত করে বরকত হাসিল করে থাকেন। রাশহাত ও কালাইদে জাওয়াহের।

No comments

Powered by Blogger.