শিয়া আক্বিদা ও সুন্নী আক্বিদা পর্ব-১
আল্লামা কাযী মুহাম্মদ মঈন উদ্দীন আশরাফী
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ মুসলমানদের ঐক্যের প্রতি অধিক জোর দেয়া হয়েছে।। কারণ, ঐক্যই শক্তি। ঐক্যবদ্ধ জাতি যে কোন কঠিন কাজ সহজে সম্পাদন পূর্বক সুফল নিয়ে আসতে সক্ষম। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সবাই মজবুতভাবে আকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়না”। অপর আয়াতে আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন নিশ্চয়ই এটা আমার সরল পথ। অতএব, তোমরা এপথ অনুসরণ করো। এর বিপরীত পথগুলোতে চলো না। তখন শয়তান তোমাদেরকে আল্লাহর বার্তা থেকে বিছিন্ন করে ফেলবে। (আল-কুরআন)
অনুরূপভাবে অসংখ্য হাদিস ঐক্যের গুরুত্বের উপর বিদ্যমান। অপরদিকে মুসলমানরা ঐক্যের বিষয়টি নানা ভাবে বর্ণনা করে ঐক্যের গরুত্ববোধ জাগিয়ে তোলার ও সজীব রাখার প্রতিও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কোন হাদিসে বলা হয়েছে “আল্লঅহর হাত” জামাত বা ঐক্যবদ্ধ দলের উপর। অপর হাদিসে বলঅ হয়েছে “ যে ব্যক্তি দল থেকে এক বিঘত পরিমাণ বিচ্ছিন্ন হলো সে জাহান্নামের পতিত হল। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে “যে ব্যক্তি দল ছেড়ে একা হয়ে গেল, যে জাহান্নামে পতিত হল”। এ ধরণের আরো অনেক হাদিস “মিশকাত শরীফ” এতছাম বিল কিতাব ওয়াচ্ছুন্নাহ” অধ্যায়ে বিদ্যমান রয়েছে। এমনকি রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রেখা অংকিত করে সাহাবা কেরামকে “সিরাতে মুস্তাকিত” তথা সরল ও নাযাতে পথ এবং শয়তানের অনেকগুলো পথের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। এ হাদিসটি মিশকাত শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ (র:) থেকে বর্ণিত হয়েছে।
অতএব, আমরা একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে ঐক্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে জোালোভাবে তাগিদ দিয়েছেন। কেননা, মুসলমানদের ধ্বংস অনৈক্যের মধ্যেই নিহিত। আল্লাহ ও রাসুলের পক্ষ থেকে এতো তাগিদ ও অনৈক্যের সুদুর প্রসারী ক্ষতি সম্পর্কে মুসলমানদেরকে সতর্ক করার পরও বাস্তবতা হলো, মুসলমানগণ কুরআন সুন্নাহর প্রদর্শিত পথে টিকে থাকতে পারেনি। এতো বাধা নিষেধকে উপক্ষো করে তারা বহু দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ সত্যটি অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। কারণ, “ইলমে গায়েব” বা অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের মধ্যে ভবিষ্যতে দলাদলি যে চরম আকার ধঅরণ করবে এ বিষয়েও ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই বনী ইসরাইল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। তাদের সবাই জাহান্নামে পতিত হবে, কিন্তু একটি মাত্র দল ছাড়া। তখন সাহাবা কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন হে-আল্লাহর রাসুল! নাজাতপ্রাপ্ত দল কারা? তিনি বলেন, আমি এবং আমার সাহাবাদের পথ ও মত (এর উপর প্রতিষ্ঠিত দল)”। এ হাদিসটি আবদুল্লাহ ইবনে ওরম (র.) থেকে তিরমিযী শরীফে বর্ণিত হয়েছে।
উপরোল্লিখিত হাদিস সমূহে ‘জামাত’ বা ‘দল’ ‘সিরাতে মুস্তাকিম” ও সর্বশেষ হাদিসে ‘নাজাদপ্রাপ্ত’ দল বলতে ইসলামের একমাত্র সঠিক রূপরেখা ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ কে বুঝানো হয়েছে। এটাই মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মত মতামত। বিভিন্ন নামে আবির্ভূত দল-উপদলগুলোর কেউ নিজেদেরকে ‘আহলে সুন্নাত’ দাবি করলেও দলিল দ্বারা তা প্রমাণিত করতে পারবে না। এটা নিশ্চিতভাবে আমরা দাবি করি। মিশ্কাত শরীফের সর্বঅধিক আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মিশকাত’ কিতাবে এতবিষয়ে নিশ্চয়তা সহকারে বলা হয়েছে যে, নাজাতপ্রাপ্ত দল ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত। উল্লেখ্য যে, অনেক নিকট অতীতে প্রকাশিত ভ্রান্ত দলের অনুসারীগণ নিজেদের ভ্রান্তি লুকানোর উদ্দেশ্যে বলে থাকে- “আমার বাহাত্তর তো শত শত বৎসর পূর্বেই পূর্ণ হয়ে গেছে।” তাদের এ ধরণের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও চরম ধোঁকাবাজী। কেননা আলোচ্য হাসিদে তিয়াত্তর সংখ্যাটি নির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝানোর জন্য নয় বরং আধিক্য বুঝানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত। অন্যথায় উল্লেখিত সংখ্যাটি পূর্ণ হবার পর আবির্ভূত কোন দলের আক্বিদা বিশ্বাস যতই ভ্রান্ত ও কুফরি হোক না কেন তাদেরকে বাতিল বলা যাবে না, এটা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য মত হতে পারে না। তাই মুহাদ্দিসগণ সংখ্যাটি আধিক্রেল অর্থে ব্যবহৃত বলে মত প্রকাশ করেছেন। যেমন, ‘মিশকাত’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে অতএব, কোন দল বা সম্প্রদায় সম্পর্কে হক-বাতিল মন্তব্য করার পূর্বে তাদের দলীয় আক্বিদা বিশ্বাস কেমন তা অবশ্যই যাচাই করতে হবে। অতঃপর কোরআন সুন্নাহর আলোকে নির্ভূলভাবে যাচাই করে দেখতে হবে। উল্লেখ্য যে, যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তবেতাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহেদীন, সালফে সালেহীন এর ব্যাখ্যাকে প্রধান্য দিতে হবে। অন্যথায় চরম ভ্রান্তির স্বীকার হতে হবে। অনেকে বলেন-প্রত্যেক দলই তো কুরআন-হাদিসের আলোকেই নিজেদের মতবাদ প্রচার করে চলেছে। এখানে কোনটা হক আর কোনটা বাতিল সেটা বুঝার উপায় কি? এটা তো বাস্তব সত্য যে, কোন দল বা সম্প্রদায় নিজেদের মতাদর্শের পক্ষে কুরআন সুন্নাহকে বাদ দিয়ে অন্য পথে প্রমাণ করতে চাইলে তা মুসলমান মাত্রই কোনভাবে গ্রহণ করবে না। তাই তারা ভ্রান্তিপ্রচারের কিন্তু ব্যাখা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহর বাহ্যিকভাবে আশ্রয় নেবে। কিন্তু ব্যাখা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যতটুকু কৌশল আছে তা অবলম্বন করবে। এটাই এ যাবত ইসলামের নামে আবির্ভূত সকল বাতিল দল উপদলের উল্লেখযোগ্য কৌশল। এ কারণেই প্রখ্যাত সাহাবী, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর সুযোগ্য সন্তান হরযত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) খারেজী সম্প্রদায়কে সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট হিসেবে বিবেচনা করতেন। কারণ, তারা কাফিরদের ব্যাপারে অবর্তীণ আয়াতগুলোকে ঈমানদারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করত। (বুখারী শরীফ ২য় খন্ড)
একশ্রেণির সরলপ্রাণ মুসলমান কোন বাতিল ফেরকাকে এ কারণে বাতিল বলতে রাজি হয় না, তারা তো নামায রোযা আদায়ে বেশ অগ্রগামী ও যতœবান। এরা কেমনে বাতিল বা গোমরাহ হবে! এরা ফযর, সুন্নাত-মোস্তাহাব ইত্যাদি পালনে বেশ যতœবান ও উৎসাহী, তারা কি করে পথভ্রষ্ট হতে পারে! সেক্ষেত্রে আমাদেরকে সাহাবা কেরামদের অনুসরণ করতে হবে। খারেজীদের নামায, রোজা, তেলাওয়াতের কুরআন ইত্যাদি বিষয়ে অতীব যতœবান দেখার পরও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রঃ) কেন তাদেরকে সৃষ্টির সবচেয়ে নিকৃষ্ট মনে করতেন, তা কারণসহ একটু আগেই সহীহ বুখারী শরীফের রেফারেন্সে আলোচনা করেছি। আমাদেরকেও এক্ষেত্রে শুধু তাদের নামায,রোযা, তেলাওয়াত বা ইসলামী বিধি-বিধান পালনে যতœবান দেখেই তাদেরকে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে বিশ্বাস করলে আমরা মারাত্মক ভুল করব।বরং দেখতে হবে তাদের আক্বীদা বিশ্বাস। আর তারই আলোকে কোন ফেরকা বা দলকে হক বা বাতিল হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। যেমনিভাবে অনেক সুন্নী পরিবারের লোকজন এভাবেই নিজের অজান্তে গোমরাহির স্বীকার হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে এ অধমের লিখিত ‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামের মূল ধারা ও বাতিল ফেরকা’ নামক গ্রন্থটি মনযোগ সহকারে পড়–ন। এতে শিয়া, ওহাবী, মওদুদী তাবলিগী সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য পন্থায় প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি।
ইসলামের ইতিহাসে-ইসলামের নামে আবির্ভূত দলসমূহের মধ্যে শিয়া ও খারেজী সবচেয়ে প্রাচীন। অর্থাৎ এদের আত্মপ্রকাশ সাহাবা-ই কেরামের যুগেই ঘটেছে। সুতরাং এটা পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হিংসা-বিদ্বেষের কারণে কারো বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলে উড়িয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। এ যাবৎ আবির্ভূত বাতিল ও ভ্রান্ত দল উপদলের মধ্যে শিয়া সম্প্রদায় এর ইতহাসই বেশ দীর্ঘ এবং এদের উপদলের সংখ্যা ও অনেক বেশি। এক পরিসংখ্যানে শিয়া সম্প্রদায়ের উপদলের সংখ্যা তিনশত বলেও প্রমাণিত হয়েছে। (দেখুন-“মিন্ আকায়েদিশ শিয়া” আরবী ভাষায় লিখিত পুস্তিকা) অনুরূপভাবে বিশ্বখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনে জৌযীর (রঃ) (ওফাত ৫৯৭হিঃ) লিখিত প্রামাণ্যগ্রন্থ “তালবিসে ইবলিস” নাকম কিতাবেও শিয়াদের উপদল সমূহ এবং তাদের আক্বিদা বিশ্বাসের উপর দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। এ সম্প্রদায়টির ইতিহাস যেমন দীর্ঘ তেমনি বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য বিনষ্টের ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা অনেক। আজকের ইরাক সমস্যার পেছনেও তাদের ভূমিকা রয়েছে তা আজ প্রমাণিত সত্য। নিন্মে শিয়া সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও তাদের ভ্রান্ত আক্বিদায় বিশ্বাস এর বর্ণনা পেশ করা হলো।
শিয়া ফিরকা: হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযুর করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, তোমরা দৃষ্টান্ত কিছুটা ঈসা আলাইহি সালামের মত। ইয়াহুদীগণ তাঁর প্রতি শক্রতা পোষণ করত। তাঁর মা (হযরত মরিয়ম আলাইহিস সালাম) এর প্রতি অপবাদ দিয়েছে। আর নাসারাগণ তাঁকে অধিক ভালবেসে তাঁকে ঐ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করলো, যা তাঁর জন্য শোভনীয় নয়। অর্থাৎ (তাঁকে ইবনুল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র বলে আক্বিদা পোষণ করে। অতঃপর হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন, আমাকে কেন্দ্র করে দু’ব্যক্তি (অর্থাৎ দু’ধরণের মানুষ ধ্বংস হবে। প্রথমতঃ আমাকে সীমাতিরিক্ত মুহাব্বতকারী, যে আমার এমন প্রসংশা করবে যা আমার মধ্যে বিদ্যমান নেই। দ্বিতীয়তঃ আমার প্রতি শত্রæতা পোষণকারী, এটা তাকে আমার প্রতি অপবাদ দিতে উৎসাহিত করবে। (মাসনাদে আহমদ)। আলোচ্য হাদিসে হযরত মাওলা আলী মুশকিল কোশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে সীমাতিরিক্ত মুহাব্বতকারী বলতে শিয়াদেরকে বুঝানো হয়েছে। আর তার প্রতি শত্রæতা পোষণকারী বলতে খারেজীদেরকে বুঝানো হয়েছে। উভয় দল হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে কেন্দ্র করে চরম লাগামহীনতার পরিচয় দিয়েছে। একমাত্র আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতই হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলঅ আনহুর মর্যাদার যথাযথ সংরক্ষণ করেছেন।
প্রকাশিত:
মাসিক আর-রায়হান
৩য় বর্ষ, ২৮ সংখ্যা, রবিউল সানি ১৪৩৮ হিজরী,
জানুয়ারী ২০১৭ ইং, মাঘ-১৪২৩ বঙ্গাব্দ।
No comments