ইসলাম প্রচারে অবদান :
বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে সুফিয়ায়ে কেরামের ভূমিকা সর্বজনবিধিত। তাঁরা তাঁদের উন্নত চরিত্র, উদার ভাবধারায় এত সহজে মানুষের অন্তরকে জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা শক্তি ও তলোয়ারের মাধ্যমে সম্ভব হয়নি ও হবেও না।
মানবজাতির হেদায়তের ক্ষেত্রে তাদের দু’টি দিক সর্বাধিক প্রণিধানযোগ্য। একদিকে আদর্শ, উন্নত চরিত্র, উদারতা, সর্বসাধারণের সাথে মেলামেশা, বিন¤্র মনোভাব, উত্তম মুয়ামালা ইত্যাদিতে তাঁরা ছিলেন অদ্বিতীয়, ফলে তাঁরা খুব সহজে খুব দূরের মানুষকে কাছে আনতে এবং শত্রুকেও বশ করতে সক্ষম ছিলেন। যেমনটি দেখা যায় হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলাইহির জীবনে।
অন্যদিকে তাঁদের ওয়াজ-নসিহতের মাহফিল ও বৈঠক, যাতে মুসলিম ও অমুসলিম সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল উম্মুক্ত। ফলে তাঁদের আলোচনা দ্বারা মানুষের জীবনে এক আমুল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতো। আর তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি। প্রাথমিকভাবে মজলিস আরম্ভ হয়েছিল দুই তিন জনকে নিয়ে, কিন্তু তাঁর মধুরবাণী ও সুমিষ্ট ওয়াজ-নসিহতে মানুষ বিমুগ্ধ হয়ে দলে দলে লোক আসতে শুরু হলো। এমনকি তাঁর এক একটি মজলিসে সত্তর হাজারেরও অধিক মানুষ অংশগ্রহণ করতো। তাঁর মাদরাসায় বসার জায়গা সংকুলান হচ্ছিলনা বিধায় বাগদাদের মহাসড়কে তাঁকে ওয়াজ-নসিহত করতে হতো। এভাবে তিনি দীর্ঘ ৩৩ বছর মানুষকে হেদায়ত করেন। ‘ফলে তাঁর এমন কোনও মজলিস ছিলনা যেখানে অসংখ্য বিধর্মী ইসলাম গ্রহণ করতো না। পাশাপাশি অসংখ্য ডাকাত, খুনি, পাপাচারী ও অপরাধীতো আছেই যাঁরা তাঁর হাতে তাওবা করে, সঠিক পথে ফিরে আসতো। [বাহজাতুল আসরার, পৃ. ৯]
আল্লাহ্ তায়ালা প্রদত্ত এ অনুগ্রহের কথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন ‘‘আমার হাতে পাঁচ হাজারেরও অধিক ইয়াহুদি ও খ্রিস্টান ইসলাম গ্রহণ করেছেন।’’ [বাহজাতুল আসরার, পৃ. ৮]
গবেষক জামালুদ্দিন ফালেহ্ জিলানী তাঁর ‘ইমাম আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি নামক কিতাবে লিখেছেন সবচেয়ে প্রাচীনতম তরিকা হলো কাদেরিয়া তরিকা। এ তরিকার প্রবর্তকের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো তিনি এমন একটি প্রজন্ম গঠনে মহান ভূমিকা রেখেছেন যারা বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফকে খ্রিস্টান দখলদারমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এ কাদেরিয়া তরিকার অনুসারীদের অন্যতম ছিলেন বিম্ববিজয়ী সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, আবদুল কাদের জাজায়েরী, ওমর মুখতার, জেনারেল আবদুর রহমান, রফিক আলী আল জিলানীসহ এ উম্মতের গৌরব করার মত আরও অনেকেই।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি শুধুমাত্র উন্নত আদর্শ, উদারতা, মানবপ্রেম, ওয়াজ নসিহত ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করেননি বরং বিশ্বব্যাপী ইসলামের আলো বিতরণ করার জন্য তাঁর খলীফা, মুরিদ ও শিষ্যদের নিয়ে এমন একটি জামাত গঠন করেন যারা দ্বীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন। যাঁদের হাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁদের একটি দল হযরত আবদুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি জীবদ্দশায় ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেন।
হযরত আবদুল কাদের জীলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সরাসরি খলিফা হলেন হযরত বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি, যিনি বড়পীর সাহেবের জীবদ্দশায় এবং তাঁরই নির্দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং বাংলাদেশেই শাহাদত বরণ করেন। তিনিই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম খানকায়ে কাদেরিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। অনুরূপভাবে হযরত শাহ্ মখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি যিনি গাউসে পাকের পৌত্র (নাতী) ছিলেন, রাজশাহীতে ইসলাম প্রচার করেন।
হেলী কারবার দানকোচ বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের কোকাজের মুসলমানগণ এখনও হানাফী মাযহাব এবং কাদেরিয়া তরিকার অনুসারী-কমিউনিউজিয়ামের শাসন ক্ষমতা সত্ত্বেও তাঁদেরকে তাঁদের ঘরে কাদেরিয়া তরিকার ওয়াজিফা পাঠ করতে শুনেছি।
বিশ্বজুড়ে কাদিরিয়া তরিকা :
শরীয়ত তরীকত হাক্বীকত ও মা’রিফাতের সমন্বয়ে যে ইলম সম্বলিত ও বিকশিত হয়েছে তাকে বলা হয় ‘ইলমে তাসাওউফ’ বা তাসাওউফ বিজ্ঞান। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই এলমে তাসাওউফ চর্চা সূচিত হয়েছে।
কুরআন মজীদে যে তাযকীইয়ায়ে নফস এবং হাদীস শরীফে যে ইহসানের কথা বলা হয়েছে সেটাই মূলতঃ তাসাওউফের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তাসাওউফ চর্চায় বিভিন্ন পদ্ধতি কালক্রমে কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিন্যাসিত হয়েছে যেগুলো ত্বরীকা নামে পরিচিত। কাদেরিয়া তরিকা তরিকাসমূহের মধ্যে বহুল প্রচলিত।
ইলমে তাসাওউফে যে সমস্ত তরীকা রয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তরীক্বা হিসেবে বিবেচিত হয় গাউসুল আযম কর্তৃক বিন্যাসকৃত কাদেরিয়া তরিকা। এ তরিকার বিস্তৃতি ঘটেছে বিশ্বের নানা দেশে ব্যাপকভাবে, যা অন্য সব তরীকার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। যে কারণে গাউসুল আযমের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে প্রসারিত হয়েছে। কাদেরিয়া তরিকা অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু খানকা গড়ে উঠেছে।
কাদেরিয়া তরিকা প্রসারিত হয়েছে পৃথিবীর সর্বত্র। এটাই শ্রেষ্ঠ তরিকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সারা পৃথিবীতে কাদেরিয়া তরিকার নিসবত বা সম্বন্ধ অনুযায়ী অসংখ্য খানকা শরীফ রয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশে প্রায় সবগুলো দেশে বিশেষ করে মিসর, লিবিয়া, সুদান, নাইজার, নাইজিরিয়া, মালী, তিউনিসিয়া, মরক্কো, মৌরিতানিয়া প্রভৃতি দেশে এই তরীকার ব্যাপক চর্চা রয়েছে। এশিয়া মহাদেশে এবং ইউরোপ ও আমেরিকাতেও এর চর্চা রয়েছে। বাংলাদেশে কাদেরিয়া তরিকার সূচনা হযরত শাহ্ জালাল রহমাতুল্লাহি আলায়হির মাধ্যমে।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে কাদেরিয়া তরিকা :
বাংলাদেশে কাদেরিয়া তরিকার প্রভাব ব্যাপকভাবে রয়েছে। যতদূর জানা যায় হযরত শাহ্ জালাল রহমাতুল্লাহি আলায়হি রাজশাহীর শাহ্ মাখদুম রহমাতুল্লাহি আলায়হি, পশ্চিম বাংলার হযরত মনসূর বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ অঞ্চলে এ তরীকার ব্যাপক প্রসার ঘটান।
বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি
যে ক’জন প্রখ্যাত সুফি সাধক ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে বাবা আদম রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন অন্যতম শক্তিশালী আধ্যাত্মিক ওলি। ভারতে মধ্যযুগে যে ক’জন সুফি দরবেশ ইসলাম প্রচারের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন বাবা আদম তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারে উদ্দেশ্যে ১২ জন আরবীয় নাগরিক নিয়ে বাণিজ্য জাহাজযোগে চট্টগ্রাম পৌঁছান।
খোরাসান প্রদেশে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর বাবা আদম রহমাতুল্লাহি আলায়হি উচ্চ শিক্ষার জন্য বাগদাদের নিজামিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। নিজামিয়া মাদরাসা থেকে উচ্চ শিক্ষালাভের পর তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বাগদাদে হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির সাহচর্যে আসেন এবং তাসাওফের শেষ স্তর অতিক্রম করেন।
তিনি প্রথমে মহাস্থানগড়ে খানকায়ে কাদেরিয়া স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। কয়েকবার সম্মুখ ও নৌ-যুদ্ধ হয়েছিল বাবা আদমের সঙ্গে বল্লাল সেনের। ১১৭৪ সালে বিক্রমপুরে বাবা আদম শহীদ হন। শহীদ হওয়ার পর তাকে রিকাবী বাজার দীঘিরপাড় সড়কের পাশে দাফন করা হয়।
হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি
রাজশাহীতে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যাদের নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাদের অন্যতম। ওলীকুল শিরোমণি হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির প্রিয়তম পৌত্র হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ ছিলেন সে মহান সাধক যিনি রাজশাহীর মত অনগ্রসর স্থানে ইসলামের মহান বাণী প্রচার করে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করেছিলেন। তৎকালীন মহাকালগড়ে (বর্তমানে রাজশাহী) দেও রাজাদের অন্যায়-অনাচার, অবিচার ও নানা কুসংস্কার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। বিশেষ করে মানুষ বলি দেয়ার মত নিষ্ঠুর কাজে জনগণ ছিল অতিষ্ঠ। আল্লাহ্ তায়ালার অশেষ মেহেরবাণীতে হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ অঞ্চলের মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা ও অত্যাচার থেকে মুক্ত করে শান্তির নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
হযরত সায়্যিদুনা আবদুল কাদের জিলানী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একটি নাম, যাঁর কারামত জন্মলগ্ন থেকে একে একে বিকশিত হয়েছে। যা কিনা মুসলমানদের উপলব্ধির বিষয়। নিম্নে গাউসে পাক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর জন্মের সময় প্রকাশ হওয়া কারামাতসমূহ বর্ণনা করা হল।
জন্মঃ হযরত সায়্যিদুনা আবদুল কাদের জিলানী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ৪৭০হিজরীতে (১০৭৫খ্রিষ্টাব্দ) পবিত্র রমজান মাসের জুমার দিন এই ধরণীতে তাশরীফ আনেন। “মানাকেবে মিরাজিয়া” নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জন্মকালীন তাঁর চেহারা প্রতিভাত হচ্ছিল যেন চন্দ্রের কিরণ। মনে হয়েছিল সমগ্র ঘর উদ্ভাসিত হয়ে গেছে চাঁদের আলোয়।
তাঁর আব্বাজানের নাম হযরত আবু ছালেহ মূসা জঙ্গী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং তাঁর আম্মাজানের নাম হযরত উম্মুল খায়ের ফাতিমা রহমাতুল্লাহি আলাইহা। তাঁরা উভয়ই ছরকারে মদীনা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বংশধর অর্থাৎ একজন হাসান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং অন্যজন হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর পবিত্র বংশধর। এ জন্য “আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁ বেরলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত “হাদায়েক্বে বখশীশ” কাব্যগ্রন্থে’ সুন্দর বলেছেন –
“আপনি কেন হাসানী এবং হুসাইনী আর মহিউদ্দীন হবেন না?
যেহেতু আপনার বংশধারা দুই সাগরের সাথে মিলিত হয়েছে।”
হযরত সৈয়্যদ আবদুল কাদের জিলানী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর জন্মের সময় অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি যখন দুনিয়ার বুকে তশরীফ আনেন তখন তাঁর আম্মাজানের বয়স ছিল ষাট। যে বয়সে সাধারণত মহিলাদের গর্ভধারণের ক্ষমতা লোপ পায়। এটাও গাউছে পাকের এক বৈশিষ্ট্যের কারণে যা আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে পেয়েছেন।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মানুষের কাছে মাহবুবে সুবহানী, কুতুবে রাব্বানী, গাউসুল আজম, গাউসুস সাক্বলাঈন, মহিউদ্দীন এবং সায়্যিদুল আউলিয়া হিসেবে পরিচিত। হযরত আল্লামা আবদুর রহমান জামী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন –
“আঁ শাহ্-এ-ছরফরাজ কে গাউসুস সাক্বলাঈন আস্ত”
অর্থাৎ – তিনিই উচ্চ মর্যাদাবান বাদশাহ্ যিনি গাউসুস সাক্বলাঈন নামে জগতে পরিচিত।
মানাকেবে গাউসিয়া নামক কিতাবে শায়খ শিহাবুদ্দীন সোহ্রাওয়ার্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন – হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর জন্মের সময় গায়েব হতে পাঁচটি আজিমুশ্শান কারামত প্রকাশ পেয়েছে।
(১) যে রাত্রিতে গাউসে পাক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জন্ম লাভ করেন ঐ রাতে তাঁর সম্মানিত আব্বাজান আবু ছালেহ মূসা জঙ্গী রহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বপ্নে দেখলেন যে, সরওয়ারে কায়েনাত, ফখরে মওজুদাত, আহমদ মুজতবা মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে সাথে নিয়ে তাঁর ঘরে তশরীফ আনলেন এবং ঐ ঘরে সমস্ত ইমাম ও আউলিয়ায়ে কেরাম উপস্থিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূসা জঙ্গী রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে সম্বোধন করলেন-
“হে আবু ছালেহ! আল্লাহ্ তায়ালা তোমাকে এমন এক সন্তান দান করেছেন যিনি অলিকুল শিরোমনি এবং আমার সন্তান। সে আমার এবং আল্লাহর বন্ধু। অচিরেই তাঁর মর্যাদা অলিদের এবং কুতুবদের মধ্যে এমন হবে যেমন আমার মর্যাদা অন্যান্য নবীদের উপর।”
কবি সুন্দর বলেছেন-
গাউসে আজম দরমিয়ানে আউলিয়া
চুঁ জনাবে মুস্তফা দর আম্বিয়া।
অর্থাৎ,নবীগণের উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যে ফজিলত, গাউসে পাকেরও অন্যান্য অলিদের উপর সেই ফজিলত।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই বাণীর দিকে ইঙ্গিত করে আ’লা হযরত বলেন –
জো অলী কব্ল থে ইয়া বা’দ হুয়ে ইয়া হোঙ্গে
ছব আদব রাখতে হ্যাঁয় দিল মে মেরে আক্বা তেরা।
অর্থাৎ, যে সমস্ত অলি গাউসে পাকের আগে এবং পরে হয়েছেন সবাই তাঁদের অন্তরে আমার গাউসে পাকের মুহাব্বত রাখেন।
(২) গাউসে পাক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর জন্মের সময় দেখা গেল তাঁর কাঁধ মোবারকের উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র কদম শরীফ (অর্থাৎ পদ চিন্হু) ছিল। যা তাঁর অলীয়ে কামিল হওয়ার সুস্পষ্ট দলিল বহন করে।
(৩) গাউসে পাকের পিতাকে আল্লাহ্ তায়ালা স্বপ্নে সুসংবাদ দিলেন যে, তোমার যে সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে তিনি সমস্ত অলিদের বাদশাহ্ হবেন। যারা তাঁর বিরোধিতা করবে তারা পথভ্রষ্ট এবং ধর্মহারা হবে।
(৪) যে রাতে গাউসে পাক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জন্ম গ্রহণ করেন সে রাতে জিলান শহরের যে সমস্ত মহিলা সন্তান প্রসব করেন তারা সবাই আল্লাহর ইচ্ছায় ছেলে সন্তানের জন্ম দেন এবং পরবর্তীতে সেসব ছেলে সন্তান আল্লাহর অলী হয়েছেন।
(৫) গাউসে পাকের জন্ম মাস ছিল রমজানুল মোবারক। তিনি সে দিন থেকে রোযা রাখা আরম্ভ করলেন। সেহ্রী থেকে ইফতারের পূর্ব সময় পর্যন্ত কিছুই খেতেন না। তাঁর সম্মানিত পিতা বর্ণনা করেন- আমার সন্তান যখন দুনিয়ার মধ্যে তশরীফ আনেন তখন রমজান মাস ছিল। সারা দিন দুধ পান করতেন না। তাঁর জন্মের দ্বিতীয় বৎসরে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় রমজানের চাঁদ দেখা যায়নি। তাই লোকজন আমার ঘরে এসে এ ব্যাপারে জানতে চাইলেন। তখন আমি তাদেরকে বললাম- আমার আবদুল কাদের আজ দুধ পান করেনি । এরপর তৎকালীন ইমামগণ ঐক্যমতে পৌঁছলেন যে, নিশ্চয়ই আজ রমজানের দিন।
গাউসে পাক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কিছুদিন পর তাঁর প্রিয় পিতাকে হারান। সে সময় তাঁর প্রিয় নানা তাঁর কর্তৃত্বের ভার নেন। তাঁর নানা ছিলেন তৎকালীন প্রখ্যাত বুজুর্গ ব্যক্তি। তিনি তাঁর পবিত্র নাতিকে অলিয়ে কামেল করার জন্য দোয়া করলেন।
ছোটবেলা থেকে গাউসে পাক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খেলাধুলা থেকে বিরত থাকতেন। অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জীবন যাপন করতেন। অতিরিক্ত কথাবার্তায় বলতেন না। গাউসে পাক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন – আমি যখন অন্যান্য ছেলেদের সাথে খেলা করার ইচ্ছা করতাম তখন আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন অদৃশ্যে থেকে বলতেন – হে আবদুল কাদের! খেলাধুলা থেকে বিরত থাক। – (খোলাছাতুল মফাহির)
বর্ণিত আছে যে, যখন তিনি পড়ার উপযুক্ত হলেন, তখন তাঁকে মক্তবে ভর্তি করানো হয়েছিল কোরআনুল করীম পড়ার জন্য। উস্তাদের সামনে তিনি নম্রতার সাথে বসলেন, উস্তাদ বললেন- পড়ূন! “বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম” । তিনি বিসমিল্লাহ্ এর সাথে সূরা বাক্বারার শুরু থেকে পড়তে আরম্ভ করেন। উস্তাদ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- কী ব্যাপার? তিনি উত্তর দিলেন হে প্রিয় উস্তাদ, আমিতো এই কোরআন আমার মায়ের মুখে মুখে গর্ভাবস্থায় শিখেছি (সুবহানাল্লাহ্)।
হুজুর গাউসে পাক রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন- আমি যখন মাদ্রাসায় যেতাম তখন এক ফেরেশতা আমার সাথে থাকতেন এবং আমাকে দিক নির্দেশনা দিতেন।-(কালায়েদে জাওহার)
হুজুর গাউসে পাক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন – এক ফেরেশতা আমার সাথে সাথে চলতে চলতে গন্তব্য স্থানে গিয়ে বলেন- হে লোকেরা আল্লাহর অলীর জন্য জায়গা করে দিন যাতে তিনি বসতে পারেন। অন্যান্য ফেরেশ্তা ঐ ফেরেশতাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি কে? ফেরেশতাটি জবাবে বলেন- তিনি হলেন অলীদের সরদার। -(বাহজাতুল আসরার)
হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু জিলানের এক মকতবে অধ্যয়নরত ছিলেন। ইত্যবসরে তাঁর কফিল (অভিবাভক) নানাজান ইহজগৎ ত্যাগ করেন। তখন তাঁর সম্পূর্ণ দায় -দায়িত্ব বর্তায় তাঁর আম্মাজানের উপর। একদিন তিনি রাস্তা দিয়ে হাটছিলেন । হঠাৎ আওয়াজ এল – “মা লিহাজা খুলিক্বতা ওয়ালা বিহাজা উমিরতা” অর্থাৎ হে আবদুল কাদের ! আপনাকে এজন্য সৃজন করা হয়নি। কথা শুনার পর তাঁর অন্তরে আল্লাহর মুহাব্বত যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আঁছড়ে পড়ছিল । এরপর তিনি আল্লাহ্কে পাবার জন্য মুরাকাবা, মুশাহাদায় লিপ্ত হয়ে যান এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে শরীয়ত ও তরীক্বতের কাজ করার লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেন।
Subscribe to:
Post Comments
(
Atom
)
No comments