হযরত খfজা আযিযানে আলী রামেতিনি রহমাতুল্লাহি আলাইহি

হজরত খাজা আলী রামেতিনি কুদ্দিসা সিররুহু (585-715 হি)
হজরত খাজা আলী রামেতিনি মাজার

তরিকতের পথে তিনি হজরত খাজা মাহমুদ আঞ্জীর ফাগনবী র. এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। যখন খাজা মাহমুদের ইন্তেকালের সময় ঘনিয়ে এলাে, তখন তিনি খাজা আলী রামেতিনিকে খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণ। করেন এবং তাঁর সকল মুরিদকে তাঁর দায়িত্বে ন্যস্ত করেন। তিনি রামেতিন। নামক স্থানে জন্মলাভ করেন। রামেতিন বােখারা প্রদেশের একটি বড় গ্রামের নাম। যা মূল শহর থেকে মাত্র দু’ক্রোশ দূরে অবস্থিত। রাশহাত ৩৪-৩৫ পৃষ্ঠা।

তিনি হজরত খিজির আ. এর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁরই নির্দেশে তিনি হজরত খাজা মাহমুদের নিকট বায়াত গ্রহণ করেন। পূর্বেই এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করা হয়েছে। তিনি উচ্চ মাকাম, কামালত, কারামত ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। যুগের বিবর্তনের কারণে রামেতিন এলাকা থেকে বাওয়ার্দ শহরে হিজরত করেন এবং বেশ সময় সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। সবাইকে আল্লাহর পথে আহ্বান করেন এবং হেদায়াতের কাজে পূর্ণরূপে আত্মনিবেশ করেন। শেষে বাওয়ার্দ শহর থেকে খাওয়ারিজমে চলে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে সাধনা ও মুজাহাদায় লিপ্ত থাকেন। খাওয়ারিজম শহরে তাঁর কাজের বিস্তৃতি ঘটে। তিনি অনেক উত্তম। চরিত্র ও গুণাবলীর ধারক-বাহক ছিলেন। অনেক লােক তাঁর মুরিদ ছিলাে। খাওয়ারিজমবাসী তাকে খাজা আলী বাওয়ার্দী এবং বােখারাবাসী আলী রামেতিনি বলে ডাকতাে। আর সুফিগণ তাঁকে বলতেন ‘আজিজান'। তিনি কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই ‘আজিজান’ শব্দ ব্যবহার করতেন। তাই তাঁকে ‘আজিজান’ বলা হতাে। রাশহাত ৩৫ পৃষ্ঠা।
তিনটি প্রশ্ন ঃ শায়েখ আলাউদ্দিন সুমনানী কুদ্দিসা সিররুহু হজরত খাজা আজিজানের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি এক দরবেশকে তিনটি প্রশ্ন করতে হজরতের দরবারে প্রেরণ করেন—
প্রথম প্রশ্ন ঃ আপনি এবং আমি আগমনকারী এবং গমনকারী লােকদের খেদমত করে থাকি। আপনি দস্তরখানার ব্যবস্থা করেন না, কিন্তু আমরা করে থাকি। তথাপি লােকজন আপনার প্রতি সন্তুষ্ট, আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট এর কারণ কী? হজরত খাজা আজিজান এর উত্তরে বলেন, উপকার করে এমন খেদমতকারীদের সংখ্যা অনেক। কিন্তু তাদের উপকারের বিষয়ে নিজের উপর অগ্রাধিকার প্রদানকারী খাদেমদের সংখ্যা খুবই কম। আপনি চেষ্টা করবেন, যাতে দ্বিতীয় প্রকারের হন। 
দ্বিতীয় প্রশ্ন : আমরা শুনেছি আপনার তরবিয়তকারী হজরত খাজা খিজির আ. এর বাস্তবতা কী? তিনি উত্তরে বলেন, আল্লাহর বান্দা সেই সত্তার প্রতি আসক্ত, হজরত খিজির যার প্রতি আসক্ত।
তৃতীয় প্রশ্ন : আমরা শুনেছি আপনি জিকরে জলি অর্থাৎ উচ্চারণময় জিকির করে থাকেন— এর কারণ কী? উত্তরে তিনি বলেন, আমরা শুনেছি। আপনি জিকিরে খফি করে থাকেন। এখন দেখি শ্রুত হওয়ার কারণে আপনার জিকিরও জলি তথা প্রকাশ্যেই হয়ে গেলাে । নুফহাত ৩৪১ পৃষ্ঠা।
ইমান কী : একবার হজরত আজিজানকে জিজ্ঞেস করা হলাে, ইমান কী? তিনি বললেন, আমিত্ব থেকে বের হওয়া এবং আল্লাহ্তায়ালার সাথে মিলিত হওয়া। নুফহাত ৩৪১ পৃষ্ঠা। 
 বাণী ঃ তিনি বলেন, হজরত মনসুর হাল্লাজের শূলিতে চড়ানাের সময় যদি খাজা আবদুল খালেকের কোনাে মুরিদ উপস্থিত থাকতাে, তাহলে তাকে শূলিতে চড়তে হতাে না। রাশহাত ৩৭ পৃষ্ঠা।
 বাণী ঃ তিনি বলেন, আল্লাহ্র সান্নিধ্যে থাকো। যদি তা না পারাে তবে যারা আল্লাহর সান্নিধ্যে থাকেন, তাঁদের সান্নিধ্যে থাকো। তাঁদের সান্নিধ্যে থাকলেই আল্লাহ্র সান্নিধ্যে থাকা হবে।
বাণী ঃ তিনি বলেন, ওই জবান (জিহ্বা) দিয়ে দোয়া করাে যার দ্বারা গুনাহ প্রকাশ পায়নি। অর্থাৎ আল্লাহর ওলীদের সামনে বিনয়াবনত হও, তা। হলে তারা তােমাদের জন্য দোয়া করবেন। রাশহাত।
বাণী ঃ তিনি বলেন, আমল করে মনে রাখার মতাে কিছুই করতে পারােনি বা যা করেছে তা ত্রুটিযুক্ত। আমল পীর সাহেব থেকে অর্জন করবে।

বাণী :  তিনি বলেন, নেককারগণের সাথে বসলে নেককার হতে পারবে। আর অসৎ লােকদের সাথে বসলে নষ্ট হয়ে যাবে। 
বাণী ঃ তিনি বলেন, তুমি যদি এমন মানুষের কাছে বসাে, যে তােমাকে আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দেয়, তাহলে তােমাকে বুঝতে হবে লােকটি মানবরূপী শয়তান। আর মানবরূপী শয়তান দানবরূপী শয়তান থেকে নিকৃষ্ট। কেনােনা দানবরূপী শয়তান গােপনে কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে, আর এরা প্রভাব বিস্তার করে প্রকাশ্যে। আর যার কাছে তুমি বসলে তার সান্নিধ্য লাভের দ্বারা যদি তােমার হৃদয়ের প্রশান্তি ও স্থিরতা লাভ না হয়, পানি ও কাদার ঘােলাটে রঙ দূর না হয়, তবে এমন ব্যক্তির সান্নিধ্য থেকে দূরে। থেকো। অন্যথা আলী আজিজানের আত্মা এই ধরনের ভুল ক্ষমা করবে না। 
নেককার বন্ধু ঃ তিনি বলেন, সৎ বন্ধুর সান্নিধ্য নেককাজ থেকে উত্তম। কেনােনা নেককাজ অহংকার ও ধােকা থেকে মুক্ত নয়। আর সৎ বন্ধু তােমাকে নেককার বানাবে ও সওয়াবের পথ দেখাবে।
আত্মঅহমিকা ঃ তিনি বলেন, অহংকারীর কাছে বােসাে না। যে ব্যক্তি অহংকার থেকে মুক্ত তাঁর সান্নিধ্যে বসাে।
দূরের ব্যক্তিও কাছে ঃ তিনি বলেন, অনেক দূরের লােক আমাদের কাছে। আর অনেক কাছের লােক আমাদের থেকে দূরে। দূরে থেকেও কাছে ওই সকল লােক, যাদের বাহ্যিক শরীর দূরে কিন্তু তাদের মন-প্রাণ আমাদের সাথেই। আবার অনেক কাছের লােক দূরে অর্থ তারা বাহ্যিকভাবে আমাদের কাছে হলেও তাদের মন-প্রাণ আমাদের সাথে নেই। তাদের মনপ্রাণ দুনিয়ার ভালােবাসা, লােভ ও কুমন্ত্রণার জালে আবদ্ধ। আমাদের নিকট যারা কাছে থেকেও দূরে থাকে, তাদের চেয়ে দূরের লােক উত্তম। 
মূলতঃ বিবেচ্য বিষয় হলাে মন ও প্রাণ। দেহ বা শরীরের (পানি ও কাদার) কাছে দূরে থাকা কোনাে বিবেচ্য বিষয় নয়।
কবি বলেন, যদি তুমি ইয়ামন দেশে অবস্থান করাে, আর আমাদের কথা তােমার স্মরণে আছে, তবে তুমি আমাদের সাথেই রয়েছে। আর যদি তুমি আমাদের সামনে উপস্থিত, কিন্তু আমাদের কথা তােমার মনে নেই, তাহলে তুমি ইয়ামন দেশে রয়েছে। 
 বাণী ঃ এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলাে, শরীয়তে বালেগ কে আর তরিকতে বালেগ কে? তিনি বলেন, শরীয়তের বালেগ সেই ব্যক্তি যার বীর্যপাত ঘটে, আর তরিকতের বালেগ সে-ই, যে অহংবােধ থেকে মুক্ত হয়। দরবেশ তাঁর কথা শুনে মাথা জমিনে স্থাপন করলাে। তিনি বললেন, জমিনে মাথা রাখার প্রয়ােজন নেই। বরং যে বস্তু মাথায় রয়েছে অর্থাৎ আত্মঅহংবােধ তা জমিনে ফেলে দিতে হবে। 
ফকির মুখাপেক্ষী নয় : তাঁর স্থলাভিষিক্ত সন্তান খাজা ইব্রাহিম তাঁকে জিজ্ঞেস করলাে, এ বাক্যটির অর্থ কী যে, ফকির আল্লাহ্র মুখাপেক্ষী নয়। তিনি বললেন, ফকির নিজের প্রয়ােজনে আল্লাহতায়ালার নিকট হাত তােলেন না। কেনােনা আল্লাহতায়ালা অদৃশ্যের জ্ঞান রাখেন। আর তিনি তাঁর সবকিছু জানেন ও দেখেন। সুতরাং তার নিকট হাত তােলার আর কী প্রয়ােজন? 
 ফকির এবং ধনী ঃ তিনি বলেন, ধনীর অর্থ হলাে অমুখাপেক্ষিতা। এ গুণটি বাহ্যিকভাবে সম্পদশালীর সাথে সাদৃশ্য রাখে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অমুখাপেক্ষিতা ফকিরীর বৈশিষ্ট্য। যেমন, কেনাে ব্যক্তি ফকিরকে কোনাে কিছু দিলাে, কিন্তু ফকির তা গ্রহণ করলাে না। কেনােনা গ্রহণ করা তার জন্য ওয়াজিব নয়। আর ধনীর না দেওয়াটা বৈধ নয়। কেনােনা দেওয়াটাই।

তার উপর ওয়াজিব। যেমন এরশাদ হচ্ছে— ( জাকাত প্রদান করাে)। আল্লাহ্পাক আরও বলেন, (আমি তাহাদেরকে যে রিজিক প্রদান করিয়াছি তাহা হইতে ব্যয় করে। সূরা বাকৃারা আয়াত ৩)

বাণী ঃ তিনি বলেন, যদি ফকির হাতে কিছু না রাখে এবং অন্তরেও কোনাে কিছুর (চাহিদা) আকাঙ্ক্ষা না রাখে, তাহলে সে উত্তম স্বভাবের ফকির। এ সম্পর্কে রসূল স. বলেন, ফকিরি আমার গর্ব। আর যদি ফকির হাতে কিছু না রাখে অথচ অন্তরে আকাঙ্ক্ষা পােষণ করে, তাহলে সে দ্বারে দ্বারে ঘােরা ভিখারীর মতাে। সে রসূলের অনুসরণকারী নয়। যদি সে আল্লাহর রসূলের অনুসরণকারী হতাে, তাহলে সে অন্তরে কোনাে কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখতাে না এবং মুখেও স্বীয় দরিদ্রতা প্রকাশ করতাে না। আর যে ফকির হাতে কিছু থাকতেই অন্যের দ্বারস্থ হয় অর্থাৎ ভিক্ষা করে, তবে সে মন্দ স্বভাবের ফকির। এ সম্পর্কে বর্ণিত আছে, দারিদ্র মুখের কালিমা। হাদিস শরীফে এসেছে— দারিদ্র কুফুরী পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয়।

বাণী ঃ একবার তার সৌভাগ্যবান সন্তান জিজ্ঞেস করলেন, হাদিস শরীফে এসেছে— অভাব অনটন উভয় জগতে চেহারাকে কালাে করে দেয় এবং অভাব কুফরের নিকটে নিয়ে যায়। আবার অন্য হাদিসে এসেছে, অভাব আমার অহংকার। এই হাদিসদ্বয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যসাধন করা যেতে পারে কীভাবে? তিনি বললেন, হাদিসদ্বয় ওই ফকির সম্পর্কে, যে সৃষ্টজীবের প্রতি মুখাপেক্ষী। অর্থাৎ যে দরবেশ মানুষের নিকট তার অভাব প্রকাশ করে। তাদের কাছে কিছু চায়। অভাব-অনটনকে সে উপার্জনের মাধ্যম বানায়। 
মূলতঃ এটা আল্লাহর প্রতি অভিযােগ করা হয়। দুনিয়াতে এটা লাঞ্ছনার কাজ। আল্লাহর প্রতি অভিযােগ করা কুফরী, আর এ কাজ পরকালে চেহারা মলিন হওয়ার উপযুক্ত। |

বাণী ঃ তিনি বলেন, ফকিরের হাত ধনীর হাত থেকে উঁচু হওয়া উচিত। কেনােনা ফকিরের হাত আল্লাহর হাতের নায়েব। রসূল স. বলেন, ‘দান সদকা ফকিরের হাতে পতিত হওয়ার পূর্বে আল্লাহর হাতে পতিত হয়।

আর আল্লাহতায়ালা বলেন, (আল্লাহর হাত তাহাদের হাতের উপর । সূরা ফাতাহ্ আয়াত ১০)।
বাণী ঃ তিনি বলেন, যদি আল্লাহতায়ালা সম্বােধন করে বলেন, হে বান্দা! আমার নিকট কিছু চাও। বন্দেগীর শর্ত হলাে, বান্দা আল্লাহ্ ব্যতীত কিছুই চাইবে না। কেনােনা যে আল্লাহকে পেয়েছে, সে সব কিছুই পেয়েছে। আর যে আল্লাহকে পেলাে না, সে কিছুই পেলাে না।
জনৈক কবি বলেন—

যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রেমে নিমজ্জিত 
সে আল্লাহ্ ছাড়া কাউকে চায় না।

বাণী : তাঁর সন্তান খাজা ইব্রাহীম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, মনসুর হাল্লাজ বলেছিলেন, ‘আনাল হক’ (আমি আল্লাহ্)। আর বায়েজিদ বলেছিলেন, আমার জুব্বার ভিতর আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই। উভয়ের কথাই শরীয়তবিরােধী ছিলাে। মনসুরকে টুকরা টুকরা করা হলাে, আর বায়েজিদকে কিছুই বলা হলাে না— এর কারণ কী? তিনি বললেন, মনসুর প্রথমে নিজের সত্তাকে তুলে ধরেছিলাে এভাবে ‘আনা’ (আমি) বলার মাধ্যমে। এজন্য তার উপর এর প্রতিক্রিয়া পতিত হয়েছিলাে। আর বায়েজীদ প্রথমে নেতিবাচক শব্দ ‘লাইসা’ ব্যবহার করেছিলেন। তাই তিনি পেয়েছিলেন নিরাপত্তা।
বাণী ঃ তিনি বলেন, আলেম চল্লিশ বছর পর্যন্ত এলেম অন্বেষণে ব্যয় করেন, মাদ্রাসায় কষ্ট সহ্য করেন, উস্তাদের খেদমত করেন— এরপর তাঁর সামান্য মর্যাদা লাভ হয়। আর আরেফ চল্লিশ বছর পর্যন্ত অভাব-অনটনে ব্যয় করেন, নিজেকে সাধনা ও ত্যাগের মধ্যে নিয়ােজিত রাখেন, বিপদ ও দুঃখ-কষ্টে সন্তুষ্ট থাকেন— যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন। এলেম আলেমদেরকে সম্মানের স্তরে উপনীত করে। আর ফকিরকে আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। প্রতিটি বৃক্ষ থেকে ওই ফল বের হয়, যা তার ভিতরে লুক্কায়িত থাকে। 
জনৈক কবি বলেন—
কলসেতে আছে যাহা
ঢালিলে পড়িবে তাহা
 বাণীঃ যদি তুমি সামনের কাতারে বসে পিছনের কাতারের লােকদেরকে তুচ্ছ মনে করাে, তাহলে তােমার জন্য উত্তম হবে পিছনের কাতারে বসা। আর সামনের কাতারের লােকদেরকে সম্মান করা। অর্থাৎ তুমি যদি গদিতে বসতে চাও, সদর (প্রধান) হতে চাও, তবে তােমার মধ্যে খাদেমের গুণাবলী থাকতে হবে। আর নিজেকে সকলের চেয়ে নিম্নস্তরের মনে করবে।
বাণী ঃ তিনি বলেন, বান্দা আল্লাহ্ হতে পারে না, তবে আল্লাহর গুণাবলীতে গুণান্বিত হতে পারে। যেমন হাদিস শরীফে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হও।
শূন্যতা ঃ একদিন তিনি বললেন, যার হৃদয় অন্যের মহব্বত থেকে শূন্য হবে, সে অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হতে পারবে না। লােকজন জিজ্ঞেস করলাে, শূন্যতা কীভাবে অর্জিত হবে? তিনি বললেন, নিজের উপরে অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে। অতঃপর বলা হলাে, প্রাধান্য দেওয়ার ফল কী হয়ে থাকে? তিনি বললেন, সওয়াব। তারা জিজ্ঞেস করলাে, নেকী বা পুণ্য কী? উত্তরে তিনি বললেন, নেকী বা পুণ্য কী তা এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা উল্লেখ করেছেন—

(তােমরা যাহা ভালােবাস তাহা ব্যয় না করা পর্যন্ত তােমরা কখনও। পুণ্যবান হইতে পারিবে না। সূরা আলে ইমরান আয়াত ৯২)। যা তুমি পছন্দ করাে, যা সবচেয়ে বেশী ভালােবাসাে তা ব্যয় না করা পর্যন্ত তুমি রসূল স. এর শাফায়াত এবং আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে না। এটাই শেষ কথা।
তাজরীদের প্রকার : উল্লেখ্য যে, হজরত খাজার বাণীতে তাজরীদ (আকাক্ষা) এর প্রকার বর্ণিত হয়েছে। তাজরীদ দুই প্রকার—১. প্রকাশ্য ২. গােপন । বাহ্যিক তাজরীদ আবার দুই প্রকার—
১. বাহ্যিকভাবেই কারাে কাছে সম্পদ, উপকরণ, রাজত্ব, পদ, বাড়ি, বাগান, দাস-দাসী বা এ জাতীয় কোনাে বস্তু বিদ্যমান নেই এবং দুনিয়ার। সম্পর্ক থেকেও সে মুক্ত। এমনকি মনে মনেও সে এই সকল বস্তুর কামনা। করে না।
২. উল্লেখিত বস্তুসমূহ তার কাছে বিদ্যমান নেই একথা ঠিক, তবে তার মনে ওই সকল বস্তুর প্রতি প্রবল আগ্রহ রয়েছে। এই ধরনের তাজরীদ (আকাক্ষা) কারাে কল্যাণ করতে পারে না। এই প্রকারের তাজরীদকারী ব্যক্তি শুধুই অভাবে কাটায়। এই প্রকারের তাজরীদ ক্ষতিকর। প্রথম প্রকার তাজরীদ উপকারী। তার অপরাধ মার্জনা করা হবে। তার নিকট ভেদরহস্যসমূহ উন্মােচন করা হবে ।
গােপন তাজরীদ হলাে মানুষের বাতেনী সম্পর্ক দুনিয়া থেকে অর্থাৎ দুনিয়ার লােভ-লালসা থেকে শূন্য হবে। অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, ধোঁকা, মিথ্যা, গীবত, আত্মঅহমিকা, কৃপণতা, অন্যকে কষ্ট প্রদান, জুলুম, নির্যাতন। ইত্যাদি অসৎ গুণাবলী থেকে মুক্ত হওয়া বরং তার বাতেন তাসবীহ, পবিত্রতা, দয়া-মায়া, এলেম, তাওয়াক্কুল, তাওহীদ, মােরাকাবা, মােজাহাদা, মােশাহাদা, জিকির, ফিকির, আনুগত্য, ইবাদত, সততা, একনিষ্ঠতা, মহব্বত ও আগ্রহ ইত্যাদি উত্তম গুণাবলীতে ভরপুর হবে। এমন তাজরীদ তাকে অভিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত করায়। এর বিনিময় বিরাট। যদি কারাে কাছে পদমর্যাদা, ধনসম্পদ, রাজত্ব, আসবাবপত্র সবকিছুই বিদ্যমান থাকে, কিন্তু তার মন এই সকলের প্রতি ধাবিত না হয়, এই সবের মহব্বত তার অন্তরে স্থান না পায়, বরং এসকল কিছু আল্লাহপ্রাপ্তির মাধ্যম ও ফানা ফিল্লাহ, বাকাবিল্লাহ্ হাসিল হওয়ার কারণ হয়, তবে এটাই গােপন তাজরীদের মধ্যে গণ্য হবে। তাই দেখা যায়, এমন অনেক নবী ও ওলী অতিবাহিত হয়েছেন, যাদের অঢেল ধনসম্পদ ও পদমর্যাদাই তাদের আল্লাহর নৈকট্য লাভের কারণ হয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম হয়েছে।

    বর্ণিত আছে- হজরত ইব্রাহিম আ. এর স্বর্ণের পৈতাপরিহিত সত্তরটি কুকুর ছিলাে। কুকুরগুলাে রাখালের সাথে বকরি চরাতাে। এ দ্বারা তাঁর ধনসম্পদ ও আসবাবপত্রের ধারণা করা যায়। তিনি ওই সকল সম্পদ আল্লাহর পরিতুষ্টির পথে ব্যয় করেন।
   এভাবে হজরত সুলায়মান আ. এর কাছে অনেক ধন-সম্পদ, আসবাবপত্র, সৈন্যসামন্ত, রাজত্ব ও মর্যাদা ছিলাে। এসকল কিছু তাঁর কোনাে ক্ষতি করতে পারেনি। কেনােনা এ সবের প্রতি তার কিছুমাত্র মহব্বত ও আকর্ষণ ছিলাে না। আল্লাহ্প্রদত্ত বস্তু প্রত্যাখ্যান করা অনুচিত। এজন্য তিনি তাঁর সকল ধন-সম্পদ ও উপকরণকে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে কোনাে ভাতা গ্রহণ করতেন না। নিজে জাম্বিল (থলে) বানিয়ে খাদেম দ্বারা বাজারে বিক্রি করে বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আর এটাই দলিল যে, তাঁর অন্তরে ধন-সম্পদ ও পদমর্যাদার কোনাে আকাঙ্ক্ষা ছিলাে না। বাদশাহ জুলকারনাইনের রাজত্বও বিশাল ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ ছিলাে। এগুলাে তাঁর কোনাে ক্ষতি করতে পারেনি। কেনােনা তিনি এগুলাের ভালােবাসাকে অন্তরে স্থান দেননি। তিনি এ সবের প্রকৃত মালিক আল্লাহতায়ালাকেই মনে। করতেন। এজন্য তিনি আল্লাহতায়ালার নৈকট্য লাভ করেছিলেন। 
  শায়েখ আবু সাঈদ আবুল খায়ের কুদ্দিসা সিররুহু প্রচুর ধন-সম্পদ ও অসংখ্য দাস-দাসীর মালিক ছিলেন। তিনি খুব সৌখিনও ছিলেন। কথিত আছে, তিনি তাঁর ঘােড়ার জুতা স্বর্ণ দিয়ে প্রস্তুত করিয়েছিলেন। লােকজন তাঁকে বললাে, এটা তাে অপচয়। উত্তরে তিনি বললেন, স্বর্ণ দুনিয়ার একটি বস্তু। আর দুনিয়াকে পায়ের নিচে রাখাই শ্রেয়।
   এই সকল কথা বলার উদ্দেশ্য হলাে, আম্বিয়া ও আউলিয়ায়ে কেরাম প্রকাশ্য ধন-সম্পদের মালিক হলেও তাদের গােপন তাজরীদ (অনাকাঙ্ক্ষা) অর্জিত ছিলাে। এজন্য তাঁরা অভিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হয়েছিলেন।
হজরত আজিজান কুদ্দিসা সিররুহু বলেন, যার গােপন তাজরীদ অর্জিত হয়নি, সে কোনােভাবেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে না।
সুস্থতা : হজরত আজিজান কুদ্দিসা সিররুহু এর নিকট এক ব্যক্তি হাদিসটির অর্থ জানতে চাইলাে— ‘সফর করাে, সুস্থ থাকবে, আর এটাকে গনিমত মনে করবে। তিনি বললেন, নিজের অস্তিত্ব থেকে আল্লাহর সত্তার দিকে সফর করাে তা হলে বিপদ থেকে মুক্ত থাকবে। আর এটাকে গনিমত মনে করবে। যখন তুমি আত্মার উন্মুক্ত প্রান্তরে ভ্রমণ করবে, তখন সুস্থতা অর্জন করতে পারবে। এরপর সন্দেহের রােগ থেকে, লৌকিকতা, প্রতারণা, লােভ, কামনা, বিদ্বেষ, শত্রুতা, হিংসা, কপটতা, কৃপণতা, আত্মঅহংকার, প্রদর্শনপ্রবণতা, লােকদের কষ্ট প্রদান এবং অন্যান্য মন্দ চরিত্রের প্রবণতা থেকে সফরের মাধ্যমে পরিত্রাণ পাবে ।।
সুতরাং সুস্থতাকে মূল্যায়ন করাে। কয়েক দিনের এই জীবনকে আনুগত্য ও ইবাদতে ব্যয় করাে।
সফলতা ও বিফলতাঃ এক লােক হজরত আজিজান কুর্দিসা সিররুহুকে জিজ্ঞেস করলাে, লােকেরা বলে, পুরুষ তিন প্রকার। পূর্ণ পুরুষ, অর্ধপুরুষ ও কাপুরুষ— এ কথার অর্থ কী? তিনি বললেন, পূর্ণ পুরুষের গুণাবলী মহান আল্লাহ্তায়ালা এই আয়াতে উল্লেখ করেছেন।
(সেই সব লােক যাহাদিগকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হইতে বিরত রাখে না। সূরা নূর আয়াত ৩৭)।
রসূল স. এর অবস্থা এমন ছিলাে যে, তিনি বলেন, আমার চক্ষুদ্বয় ঘুমায়, কিন্তু আমার হৃদয় ঘুমায় না। বােখারী, মুসলিম।
অর্ধপুরুষের বর্ণনা ঃ যে ব্যস্ততার মধ্যেও কলবের জিকিরে মজা পায় । কিন্তু সে এতােটুকুর উপরেই সন্তুষ্ট। অর্থাৎ তার অবস্থা এমন যে, যবানে জিকির জারী থাকলে তার অন্তর ওই জিকিরের স্বাদ অনুভব করে। আর যখন সে জবানের জিকির ত্যাগ করে, তখন তার কলব আল্লাহর জিকির থেকে বিরত থাকে।
কাপুরুষের বর্ণনা ঃ আর কাপুরুষ হলাে মুনাফিক। সে জিকির করে ঠিক, কিন্তু আল্লাহর জন্য জিকির করে না।


বাণী : হজরত আজিজান কুদ্দিসা সিররুহুকে একবার জিজ্ঞেস করা হলাে, মহানবী স. এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন সকালে খালেস (একনিষ্ঠ) ভাবে আল্লাহ্র জন্য পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে বিধান মতে ও খেয়ালের সাথে আল্লাহর জিকির করবে, হেকমত বা প্রজ্ঞার ঝর্ণা তার হৃদয় থেকে জবানে জারী হয়ে যাবে। হিসনে হাসীন পৃষ্ঠা ১৩।
অনেকে এই হাদিসের উপর আমল করেছে, কিন্তু কাজ হয়নি— এর কারণ কী? হজরত আজিজান কুর্দিসা সিররুহু বললেন, ওই সকল লােক সত্যবাদী নয়। তাদের বাসনা ছিলাে চল্লিশ দিনের ইবাদতের মাধ্যমে যেনাে হেকমতের ঝর্ণা তাদের হৃদয় থেকে জবানে জারী হয়ে যায়। আল্লাহর সন্তুষ্টি তাদের উদ্দেশ্য ছিলাে না। তাই তারা সফল হয়নি। | 
বাণী ঃ একদিন হজরত আজিজান কুদ্দিসা সিররুহুকে জিজ্ঞেস করা হলাে, মহান আল্লাহ্তায়ালা আযল দিবসে সকল মানুষের রূহকে সম্বােধন করে বলেছিলেন— (আমি কি তােমাদের প্রভুপালক নই? সকল রূহ বলেছিলাে, হঁ্যা। অবশ্যই তুমি আমাদের প্রভুপালক। সূরা আরাফ আয়াত ১৭২)। কিয়ামত দিবসে যখন সকল বস্তু ধ্বংস হয়ে যাবে, আত্মা ছাড়া অন্য কোনাে বস্তু বিদ্যমান থাকবে না, তখন আল্লাহতায়ালা সকল রূহকে সম্বােধন করে বলবেন ‘আজ রাজত্ব কার’ সেই সময় কারাে উত্তর দেওয়ার সাহস হবে না। তখন আল্লাহতায়ালা নিজেই উত্তর দিবেন (এক পরাক্রমশীল আল্লাহ্র । সূরা ইব্রাহিম আয়াত ৪৮)।।

এখন প্রশ্ন : এমন হবে কেনাে? সে দিন তারা চুপ থাকবে কেনাে? হজরত আজিজান উত্তরে বলেন, আযল দিবস ছিলাে শরীয়তের বিধি-বিধান স্বীকার করার দিন। এ জন্য রূহসকল হ্যা বলেছিলাে। আর আখেরাতে শরীয়তের বিধান উঠিয়ে নেওয়া হবে। সেদিন প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পাবে। কে কতােটুকু শরীয়ত পালন করতে পেরেছে, তা নিজেরাই প্রত্যক্ষ করবে। নিজেদের আমলের কারণে সকলে হবে লজ্জিত ও অনুতপ্ত। হবে ভয়ে প্রকম্পিত ও নির্বাক। অবশেষে আল্লাহ্ নিজেই বলবেন ‘এক পরাক্রমশালী আল্লাহর।

তাওয়াজ্জোহ্ ও তুহফা ঃ একবার জনৈক ব্যক্তি হজরত আজিজান কুদ্দিসা সিররুহুর কাছে আবেদন করলাে, দয়া করে আমার হালের অবস্থার প্রতি তাওয়াজ্জোহ প্রদান করুন। তিনি বললেন, বাজারে যাও এবং একটি লােটা ক্রয় করে হাদিয়াস্বরূপ আমার সামনে পেশ করাে। যখন আমার দৃষ্টি ওই লােটার উপর পতিত হবে, তখনই আমার তাওয়াজ্জোহ্ (মনােনিবেশ বা । আত্মিকদৃষ্টি) তােমার উপর পতিত হবে।
সিলকা এবং মগজ ঃ একদিন হজরত আজিজান কুদ্দিসা সিররুহুর দরবারে জ্ঞানীদের একটি দল উপস্থিত হলাে। তাঁরা কথােপকথন শুরু করলেন। আলােচনার এক পর্যায়ে একজন বললেন, উলামারা হলেন খােসা আর ফকিরেরা হলেন মগজ। হজরত আজিজান কুদ্দিসা সিররুহ বললেন, মগজ খােসার হেফাজতের কারণে নিরাপদে থাকে।
হকের সাথে মিলন ঃ একদা হজরত আজিজান কুদ্দিসা সিররুহু। মােরাকাবায় মগ্ন ছিলেন। এমন সময় একজন লােক এসে বললাে, তাসাউফ কী? তিনি বললেন, অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ এবং হক সুবহানাহু তায়ালার সাথে সম্পর্ক স্থাপন।
১. অন্যদের থেকে নিজেকে না ফেরাতে পারলে, বন্ধুর সাথে মিলতে পারবে না।
২. সৃষ্টজীবের সাথে সম্পর্ক দূর করাে, তাহলে বন্ধুর সাথে মিলনের যােগ্যতা লাভ করবে।
৩. যখন তুমি দুনিয়ার লােভ থেকে পবিত্র হবে, তখন পরকালের পথের মনজিলগুলাে দেখতে পাবে।
৪. কোনাে মঞ্জিল দেখতে পেলে তা অর্জনের চেষ্টা করবে।
৫. যখন তুমি তােমার কাজের অবস্থা জানতে পারবে, তখন তুমি নিজেকে আল্লাহ্ পর্যন্ত পৌছাতে পারবে।
বাজারী ঃ এক ব্যক্তি একবার অবজ্ঞার সাথে বললাে, আজিজান একজন বাজারী অর্থাৎ তিনি সূতা ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বাজারে ঘুরাফেরা করেন। তিনি বললেন, আল্লাহ্র নিকট কান্নাকাটি ও মুখাপেক্ষিতা খুবই পছন্দনীয়। সুতরাং আজিজান কেনাে বাজারী হবে না? অর্থাৎ আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি ও অশ্রু বিসর্জন করাে। তাঁর দরবারে অভাব অনটন ও দরিদ্রতার মূল্য অনেক।
যেমন কবির ভাষায়—
ইশকের মাকামে ক্ষমতা ও রাজত্ব মূল্যহীন
তাতে ব্যথা, অসহায়ত্ব ও বিত্তহীনতা ছাড়া আর কী রয়েছে।
 যে ব্যক্তি যতাে হীনতা, মুখাপেক্ষিতা ও বিনয় পেশ করবে, তার মর্যাদা ততাে উঁচু হবে।
কারামত ১ ঃ হজরত আজিজান কুদ্দিসা সিররুহু খাওয়ারিজম শহরে। সন্ধ্যায় সূতার বাজারে যেতেন। যাদের সূতা বিক্রি হতাে না, তাদের সকলের সূতা ক্রয় করে ঘরে চলে আসতেন। তিনি নিজ ঘরে এসে এক কোণায় মােরাকাবায় লিপ্ত হতেন। তাঁর হাত লাগানাে ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ৪০ গজ সূতি কাপড় তৈরী হয়ে যেতাে। যেমন হজরত হােসেন ইবনে মনসূর সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি এক ধুনরীকে কোনাে কাজে পাঠালেন। নিজে তার ঘরে বসে স্বীয় হাত দ্বারা ইশারা করলেন। আপনাআপনি তুলা থেকে সব বিচি পৃথক হয়ে গেলাে। তাঁর এই কারামতের কারণে তাঁর নাম হাল্লাজ হয় অর্থাৎ তুলাধুনরী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে ।
অনুরূপভাবে হজরত আজিজান র. এর উপাধি নাসাজ (কাপড় বা সূতা) প্রস্তুতকারী নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়।
মাওলানা রূমি র. বলেন-
   অভ্যন্তরীণ বিষয় যদি কথা থেকে উত্তম না হতাে, তাহলে বােখারার সরদাররা হজরত খাজা নাস্সাজ র. এর গােলামী কীভাবে অবলম্বন করলেন।
   সম্ভবতঃ এই সূতাগুলাে কোনাে অদৃশ্য ব্যক্তি বা জিন, যারা তাঁর মুরিদ ছিলাে অথবা ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশে বয়ন করে দিতেন বা এসব উপকরণ ছাড়াই কাপড় তৈরী হয়ে যেতাে যার প্রকৃত রহস্য আমাদের জানা নেই। হজরত আজিজান র. সূতার কাপড় বাজারে নিয়ে বিক্রি করতেন। এ থেকে যা লাভ হতাে তা তিন ভাগে ভাগ করতেন— একভাগ উলামাদের জন্য, একভাগ ফকিরদের জন্য, আর একভাগ নিজ পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করতেন।
কারামত ২ঃ হজরত সায়্যেদুনা, হজরত আজিজান কুর্দিসা সিররুহুর। সমসাময়িক ছিলেন। কখনাে কখনাে উভয়ের দেখা-সাক্ষাৎ ঘটতাে। হজরত আজিজান কুর্দিসা সিররুহু সম্পর্কে তার ভালাে ধারণা ছিলাে না। একবার হজরত আজিজান কুর্দিসা সিররুহুর শানে তাঁর বে-আদবীমূলক আচরণ। প্রকাশ পেলাে। হঠাৎ তুর্কিদের পক্ষ থেকে খােলা প্রান্তরের দিক হতে আক্রমণ হলাে। তাঁরা সায়্যেদুনার ছেলেকে বন্দী করে নিয়ে গেলাে। সায়্যেদুনা বুঝতে পারলেন, এটা তার বে-আদবীর ফল। তিনি ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য হজরত আজিজানের খেদমতে উপস্থিত হলেন। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে। তাঁকে দাওয়াত করলেন এবং কবুল হওয়ার আশা করলেন। হজরত আজিজান র. তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে দাওয়াত কবুল করলেন এবং তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হলেন। ওই মজলিশে সে যুগের বড় বড় মাশায়েখগণ উপস্থিত ছিলেন। হজরত আজিজান র. এক বিশেষ অবস্থায় ছিলেন। খাদেম যখন লবণদানী আনলেন এবং দস্তরখানা বিছালেন, তখন শায়েখ আজিজান র. বললেন, আজিজান ততােক্ষণ পর্যন্ত নেমকদানীতে হাত রাখবে না এবং খাদ্য গ্রহণ করবে না, যতােক্ষণ না সায়্যেদুনার ছেলে দস্তরখানায় উপস্থিত হবে। সামান্য সময় তিনি নীরবতা অবলম্বন করলেন। উপস্থিত জনতা হজরত আজিজানের কথার ক্রিয়া প্রকাশের অপেক্ষায় ছিলেন। এমন সময় সায়্যেদুনার ছেলে ঘরে পৌঁছলেন। মজলিশে শােরগােল শুরু হলাে। লােকজন বিস্ময় প্রকাশ করতে লাগলাে । তুর্কিদের কাছ থেকে তার মুক্তির ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলাে। সে বললাে, আমি এর চেয়ে বেশী কিছু জানি না যে, আমি তুর্কিদের হাতে বন্দী ছিলাম। তারা আমাকে বেঁধে তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছিলাে। এখন আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত। মজলিশের সবাই বুঝতে পারলাে, এটা হজরত আজিজান কুর্দিসা সিররুহুর কারামত। রাশহাত পৃষ্ঠা ৩৮।

কারামত ৩ ঃ একদা জনৈক মেহমান হজরত আজিজানের বাড়িতে। আসেন। তখন তার ঘরে মেহমানকে দেওয়ার মতাে কোনে আহার্য ছিলাে মেহমান অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে বাইরে বের হলেন। হঠাৎ একটি ছেলেকে খাদ্য বিক্রি করতে দেখতে পেলেন। সে ছিলাে হজরতের ভক্তদের একজন। একটি দস্তরখানায় খাবার ভর্তি করে হজরতের খেদমতে পেশ করলাে। উপযুক্ত সময়ে হাদিয়া পেশ করার কারণে খাজা তাঁর প্রতি খুবই সন্তুষ্ট হলেন। মেহমানকে খাবার খাওয়ালেন। এরপর ছেলেটিকে কাছে ডেকে বললেন, তােমার দ্বারা পছন্দনীয় খেদমত হয়েছে। তােমার যা ইচ্ছা। চাও, ইনশাআল্লাহ্ পূর্ণ করা হবে। ছেলেটি খুবই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ছিলাে। সে বললাে, আমি আপনার মতাে হতে চাই। হজরত আজিজান র. বললেন, বিষয়টি খুবই কঠিন। তােমার উপর বিশাল বােঝা চাপানাে হবে।আর তুমি তা সহ্য করতে পারবে না। ছেলেটি বিনয়ের সাথে বললাে, আমার উদ্দেশ্য শুধু এটাই। এটা ছাড়া আর কোনাে উদ্দেশ্য নেই। হজরত আজিজান র. বললেন, ঠিক আছে তাই হবে। হজরত আজিজান তার হাত ধরে পৃথক হয়ে গেলেন। তার উপর তাওয়াজ্জোহ দিলেন। এরপর ছেলেটি তার মতােই হয়ে গেলাে। আকৃতি, প্রকৃতি, জাহের, বাতেন অবিকল তাঁর মতােই হয়ে গেলাে। এরপর চল্লিশ দিবস পর্যন্ত ছেলেটি জীবিত ছিলাে। অবশেষে এই বােঝা বহন করতে না পেরে পরপারে চলে গেলাে। রাশহাত। পৃষ্ঠা ৩৯।
কারামত ৪ ঃ অদৃশ্য ইশারায় তিনি বােখারা থেকে খাওয়ারিজম গমনের ইচ্ছা করলেন। তিনি খাওয়ারিজমের মূল ফটকে গিয়ে থেমে গেলেন এবং দু’জন দরবেশের মাধ্যমে খাওয়ারিজমের বাদশাহ্র নিকট এইমর্মে খবর পাঠালেন যে, একজন ফকির আপনার দ্বারে দণ্ডায়মান। তিনি আপনার শহরে অবস্থানের ইচ্ছা করছেন। যদি অনুমতি দেন, তবে সে শহরে প্রবেশ করবে। অন্যথায় ফিরে যাবে। তিনি দূতদেরকে এটাও বলে দিলেন যে, যদি বাদশাহ অনুমতি দেয়, তবে তার সিলমােহর যেনাে নিয়ে। আসা হয়। যখন তারা বাদশাহর দরবারে পৌঁছলেন এবং হজরত আজিজান যা বলে দিয়েছিলেন তা বাদশাহকে বললেন, তখন খাওয়ারিজমের বাদশাহ্ ও তার সভাসদগণ হেসে ফেললেন। বললেন, এই দরবেশ তাে দেখছি। খুবই সাদাসিধা ও আত্মভােলা। হাসি-তামাশা ছলেই তাঁরা হজরত আজিজানের ইচ্ছানুযায়ী এজাজতনামা লিখে সিলমােহর করে তাঁর প্রেরিত দরবেশদের কাছে অর্পণ করলেন। তারা হজরত আজিজানের নিকট উপস্থিত হলেন এবং বাদশাহ্র অনুমতিপত্র পৌছে দিলেন। অনুমতি পেয়ে হজরত আজিজান র. শহরাভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। এক কোণায় বসে। তরিকায়ে খাজাগানের কাজে মশগুল হয়ে গেলেন।
তিনি সকালে শ্রমিকদের খোঁজে বের হতেন এবং প্রত্যহ দুই একজন করে শ্রমিক ঘরে নিয়ে আসতেন। তাদেরকে বলতেন, ভালােভাবে ওজু। করাে এবং পরবর্তী ওয়াক্ত পর্যন্ত আমাদের সাথে অবস্থান করাে ও জিকির করাে। এরপর পারিশ্রমিক নিয়ে চলে যেয়াে। লােকজন অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সাথে তার সান্নিধ্য গ্রহণ করতাে। একদিন পর হজরত আজিজানের সােহবত, বুজর্গী ও কারামতের প্রভাবে তারা এমন হতাে যে, তারা আর তাঁর কাছ থেকে পৃথক হতে পারতাে না। কিছু দিনের মধ্যেই ওই অঞ্চলের অধিকাংশ লােক হজরতের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। আলেম ও তালেবে এলেমগণ দলে দলে তাঁর দরবারে ভিড় জমাতে লাগলাে। খাওয়ারিজম বাদশাহর নিকট এইমর্মে সংবাদ পৌছলাে যে, এক দরবেশ এই শহরে প্রবেশের পর অধিকাংশ লােক তাঁর ভক্ত ও অনুরক্ত হয়ে পড়েছে। তাঁর খেদমতের জন্য তারা সদা প্রস্তুত। খাওয়ারিজম বাদশাহ্র ধারণা হলাে, এমন যেনাে না হয় যে, তাঁর ভক্ত ও অনুরক্ত লােকেরা দেশে কোনাে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। শেষে তা দমন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। বাদশাহ এই ধারণায় হজরতকে খাওয়ারিজম থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হজরত আজিজান র. বাদশাহ্ কর্তৃক সিল মােহরকৃত এজাজতনামা সেই দুই দরবেশের মাধ্যমে বাদশাহর দরবারে প্রেরণ করেন। তাদেরকে বলে। দেন এই কথা বলার জন্য যে, আমরা আপনার অনুমতি নিয়েই এ শহরে প্রবেশ করেছি। আপনি যদি পূর্বের অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন, তাহলে আমরা এখনই চলে যাবাে। এজাজতনামা দেখে বাদশাহ্ এবং সভাসদগণ লজ্জিত। হলেন। হজরত আজিজানের দূরদর্শিতার (এলমে ফেরাসাত) কারণে তারা তাঁর ভক্ত ও অনুরক্ত হয়ে পড়লেন। হজরতের খেদমতে উপস্থিত হয়ে তাঁর মুরিদ হলেন। রাশহাত পৃষ্ঠা ৩৯।
 কারামত ৫ ঃ হজরত খাজা আজিজান কুর্দিসা সিররুহুর দুইজন পুত্র। সন্তান ছিলেন। এক জনের নাম ছিলাে খাজা মােহাম্মদ। তিনি খাজা মুরাদ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। হজরত আজিজানের ভক্তরা তাঁকে খাজা বুজর্গ বলতেন।
দ্বিতীয় জনের নাম খাজা ইব্রাহীম। তিনি তাঁর (হজরত আজিজান) মর্যাদা ও জীবনালেখ্যসম্বলিত একটি পুস্তিকা রচনা করেন। ওই পুস্তকের অধিকাংশ ঘটনার বর্ণনাকারী তিনিই। হজরত আজিজানের পরলােকযাত্রার। সময় সমাগত হলে খাজা ইব্রাহীমকে এজাজত ও খেলাফত দান করেন। অনেকের মনে এমতাে সংশয় উদয় হলাে যে, হজরতের বড় সাহেবজাদা খাজা মােহাম্মদ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তিনি ছােট ছেলে ইব্রাহীমকে খেলাফত প্রদান করলেন কেনাে? হজরত আজিজান র. তাদের একথা বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, খাজা মােহম্মদ আমার পরে বেশী দিন জীবিত থাকবে না। অচিরেই আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে। হজরত যা বলেছিলেন তাই হলাে। হজরত খাজার ইন্তেকালের ১৯ দিন পর ৭১৫ হিজরী সনে ২৭ শে জিলহজ সত্তর বছর বয়সে সােমবার দিন চাশতের সময় খাজা মােহাম্মদ ইন্তেকাল করেন। আর খাজা ইব্রাহীম খাজা মােহাম্মদের ৭৮ বছর পর ৭৯৩ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
হজরত খাজা আজিজানের বয়স হয়েছিল ১৩০ বছর। তার ওফাতের তারিখ ৮ই জিলহজ ৭১৫ হিজরী। তাঁর এক মুরিদ তাঁর ইন্তেকালের তারিখ ছন্দাকারে ব্যক্ত করেছেন এভাবে-
আটাশে জিলহজে, সাতশত পনর হিজরী সালে
যুগের জুনাইদ ও কালের শিবলী পরপারে গেলেন চলে। 
তাঁর মাজার শরীফ রয়েছে প্রসিদ্ধ খাওয়ারিজমে। তিনি ছিলেন সূফিদের সর্দার, রহস্য জগতের সমুদ্র।
  বলাবাহুল্য, খাজা মাহমুদ আঞ্জীর ফাগনবীর দ্বিতীয় খলিফার নাম ছিলাে মীর হােসেন ওয়াবকিনী। তাঁকে মীর খুরাদও বলা হতাে। খাজা আলী রামেতিনি এবং মীর হুসাইন ওয়াবকিনী উভয়েই তাঁর খলিফা ছিলেন। তাঁরা দু’জনেই শায়েখের ইন্তেকালের পর অনেকদিন জীবিত ছিলেন। মীর হােসেন কুদ্দিসা সিররুহু তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ বুজর্গ ছিলেন। ছিলেন তালেবে। মাওলাগণের কেন্দ্রবিন্দু এবং লক্ষ্যস্থল। মীর খুরাদের কবর ওয়াবকেনা প্রদেশে। মীর খুরাদ ও মীর হােসেনের ভাই খাজা মাহমুদের মুরিদ ছিলেন। কিন্তু খেলাফত লাভ করেছিলেন খাজা আলী এবং মীর হােসেন কাদ্দাসাল্লাহু। আসরারাহুমা ।




No comments

Powered by Blogger.